অনলাইন ডেস্ক :
সিনেমা পাড়ায় ‘শক্তিমান’ বিশেষণের একটা বিশেষ প্রচলন আছে। কোন অভিনেতা দুর্দান্ত অভিনয় করলে আমরা বলি, ‘শক্তিমান অভিনেতা’। কিংবা কোন চলচ্চিত্র পরিচালক, যিনি চলচ্চিত্রের ভাষা জানেন, জানেন নন্দনতত্বের পরিমিত ব্যবহার, তাকে বলি ‘শক্তিমান নির্মাতা’। এই ‘শক্তিমানরাই’ সব কিছু পাল্টে দিতে জানেন। পুরাতনকে ভেঙে নতুন করে গড়তে জানেন। কারণ তিনি যে কাজটা করেন, সেটা বুঝে শুনেই করেন। মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) কথাই যদি বলি, সিনেমার রোমান্টিক নায়িকা ববিতাকে ভেঙে যিনি আমাকে নতুন পরিচয় দিয়েছেন, পৃথিবীর মানুষের কাছে আমি হয়ে উঠেছিলাম ‘অশনি সংকেত’-এর অনঙ্গ বউ। আমার চলচ্চিত্র জীবনে বেশ কয়েকজন শক্তিমান নির্মাতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমি পেয়েছি। এর বাইরে আরেক ‘শক্তিমানের’ সাক্ষাৎ পেয়েছি বছর পাঁচেক আগে। যিনি আমার ‘নায়িকা’ কিংবা ‘অভিনেত্রী’ পরিচয়ের বাইরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আমাকে নতুনভাবে চিনিয়েছেন। তিনি আমাদের খ্যাতিমান সাংবাদিক, নির্মাতা শাইখ সিরাজ। আমি ডাকি ‘সিরাজ ভাই’।
দেশে কিংবা দেশের বাইরে, মার্কেটে বা বিমান বন্দরে দেশের মানুষজন আমাকে দেখলেই এখন জানতে চান আমার ‘ছাদকৃষি’র খবর। কিংবা জিজ্ঞেস করেন ‘আপনার তোতাপাখিটি কেমন আছে?’ সিরাজ ভাই আমার এত দিনে গড়া সিনেমার পরিচয় ছাপিয়ে ‘ছাদকৃষক’ পরিচয়টিকে প্রমিনেন্ট করে তুলেছেন। এতেই বোঝা যায় তাঁর নির্মাণশৈলীর শক্তি। তিনি কতোটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে জানেন। ‘অশনি সংকেত’ কিংবা ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’-এর মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য বোধহয় ক্ষুধার অভিশাপ সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করতে পারি। হয়তো এ কারণেই খাদ্য উৎপাদন এবং এর সাথে যুক্ত মানুষগুলোর প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করি।
বাংলাদেশের ক্ষুধার্ত মানুষের গল্পগুলো আমাদের অজানা নয়। সত্তর বা আশির দশকের চলচ্চিত্রে উঠে আসা খাদ্যের জন্য যে হাহাকার, কৃষকের অধিকারের জন্য লড়াই। এর কোন কিছুই কল্পনা নয়। বাস্তবই প্রতিফলিত হয়েছে সিনেমার সেলুলয়েড ফিতায়। এমনই ছিলো আমাদের দেশ। আজকের নবীনরা হয়তো সেটা বিশ্বাস করতে চাইবে না। কারণ, সেই ক্ষুধা, সেই হাহাকার আজ নেই। ক্ষুধার দুঃস্বপ্ন থেকে যারা আমাদের দেশকে বের করে নিয়ে এসেছেন, তাদের একজন শাইখ সিরাজ, আমার সিরাজ ভাই। তিনি কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন কৃষিতথ্য। তুলে ধরেছেন কৃষকের কথা। কৃষিকে নিয়ে গেছেন কৃষকের বাইরে, কিংবা বলা যায় সকল শ্রেণীপেশার মানুষকে তিনি কৃষক বানাতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দেশ-বিদেশের কৃষি কৌশল আর প্রযুক্তি তুলে ধরে কৃষিকে করেছেন গ্ল্যামারাস। তরুণরা উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
বলতে বাধা নেই, আমার কৃষক হয়ে ওঠার পেছনেও ভূমিকা রেখেছেন সিরাজ ভাই। নিজের বাড়ির ছাদেই যে সতেজ ফল-ফসল ফলানো সম্ভব সেটি তাঁর অনুষ্ঠান দেখেই জেনেছি। আমি তাঁর ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ অনুষ্ঠানটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি। দেখি জন-মানুষের উচ্ছ্বাস। মেকাপহীন, ভনিতাহীন সাধারণ কৃষকের আনন্দ, খেলাধুলা দেখিয়ে তিনি কী অসাধারণভাবেই না মানুষকে মোহমুগ্ধ করে রাখেন! সেখানে একেকজন কৃষকই মূল তারকা। সত্যিকার অর্থেই সিরাজ ভাই কৃষককে তারকা বানানোর কারিগর। ছেলে অনিকের সঙ্গে আমাকে প্রায় সময়ই দেশ ছেড়ে কানাডায় থাকতে হয়। বিদেশ বিভূঁইয়ে যখন দেশের জন্য টান অনুভব করি তখন শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠানে আমি দেখি বাংলার ‘ধানসিঁড়ি নদী’।
ধান ক্ষেতে বাতাসের দোল। পাখির কলরব। নদীতীরের মানুষ, কৃষক। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ, পুরো দেশ ঘুরে তুলে ধরেন বাংলাদেশকে। তুলে ধরেন সাধারণ মানুষের কথা। নায়িকা খ্যাতির ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশা, কাছ থেকে তাদের দেখা খুব একটা হয়ে ওঠেনি। আমি সিরাজ ভাইয়ের চোখে দেখার চেষ্টা করি আমার দেশকে। বাংলাদেশকে। সিরাজ ভাই শুধু কৃষকের কথাই ভাবেননি। আমাদের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের মানুষের কথাও ভেবেছেন। তার প্রমাণ রেখেছেন রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে বানানো তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘রাজাধিরাজ রাজ্জাক’-এ।
নায়করাজকে নিয়ে এমনভাবে কেউ ভাবেনি। অথচ কিংবদন্তী মানুষগুলোর কথা আগামী প্রজন্মের জন্য তুলে রাখা প্রয়োজন। এটা ইতিহাসের জন্য যতোটা জরুরি, ততোটাই জরুরি মানুষের শিল্পী সত্ত্বাকে বিকশিত করতে। এই কাজের জন্য সিরাজ ভাইকে আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ দিতে চাই। সিরাজ ভাই বয়সে সত্তরের কোটায় এসে দাঁড়িয়েছেন। অথচ কী দারুণ তারুণ্য তাঁর ভেতর। আমার ‘ছাদকৃষি’ করতে যখন এসেছিলেন, দেখেছি তিনি কতোটা চঞ্চল। ক্যামেরাম্যানকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। বার বার ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখে নিচ্ছেন ফ্রেম ঠিক আছে কিনা। কোন্ দিকটায় দাঁড়ালে আলো ঠিকঠাক মতো পাওয়া যাবে। সব দিকেই তাঁর নজর। কাজের প্রতি তাঁর অন্যরকম দরদ। আর এ কারণেই তিনি আইকন হতে পেরেছেন। তিনি পাল্টে দিতে পেরেছেন একটা সময়কে, একটা প্রজন্মকে। সিরাজ ভাই তাঁর তারুণ্য ধরে রাখুন শত বছর, তাঁর জন্মদিনে এ প্রার্থনাই করি।
আরও পড়ুন
ইউটিউব থেকে সরানো হলো শাকিবের ‘তুফান’
চিন্তিত অনন্যা পান্ডে
কনাকে নিয়ে সুখবর দিলেন আসিফ