নিজস্ব প্রতিবেদক:
সম্ভাবনার তুলনায় দেশ থেকে সেবা রপ্তানি অনেক কম। আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। বরং দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। কোনো অর্থবছরেই সেবা রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সেবার প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার থাকলেও বাংলাদেশের অংশ গড়ে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি নয়। যা পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো। যদিও বাস্তবতা অনুযায়ী সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রাও কম করে ধরা হয়।
কিন্তু ওই কম লক্ষ্যমাত্রাও বিগত কোনো অর্থবছরে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বরং যেসব সেবা রপ্তানি করা যতো সেগুলোরই কোনো কোনোটি এখন আমদানি করা হয়। মূলত সবার নিম্নমান ও সহায়ক নীতি-কাঠামোর অভাবে দেশ সেবা রপ্তানিতে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। তবে সহায়ক নীতি-কাঠামো এবং সেবার মান উন্নত হলে সেবা খাতের রপ্তানি কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তাদের মতে, সেবা রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে ব্যবহার করা, সেবার মান উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ও অবকাঠামোর মতো বিষয়ে মনোযোগ দেয়া জরুরি। অভ্যন্তরীণ সেবা খাত দাঁড়িয়ে গেলে রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও কমে আসবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সেবা রপ্তানির তালিকায় থাকা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাতের মধ্যে রয়েছে পরিবহন, পর্যটন, ব্যাংক-বীমা, টেলিযোগাযোগ, নির্মাণ, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি, মেধাস্বত্ব ইত্যাদি। বিদেশি বিমান, জাহাজ কিংবা অন্যান্য পরিবহন বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি নিলে সেটিও সেবা রপ্তানির অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২ অনুসারে অটোমোবাইল, এভিয়েশন, পরিবহন, যোগাযোগ, ওয়্যারহাউস, সুপারশপ, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদিকে সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে গত অর্থবছরের ১০ মাস পর্যন্ত ১১ শতাংশ সেবা রপ্তানি কমেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ শতাংশের মতো আয় কম হয়েছে। মাত্র ৬৩৫ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের সেবা রপ্তানি হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০০ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, কোনো অর্থবছরেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি সেবা রপ্তানির। কোনো কোনো অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেবার পরিমাণ ছিল ৬৩৪ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমে হয় ৬০৮ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে হয়েছে ৬৬১ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের প্রায় ৯ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছর সেবা রপ্তানি আয় বেশ খানিকটা বেড়ে হয়েছে ৮৮৯ কোটি ডলার। তাও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশের মতো কম।
সেবা রপ্তানিতে খুব বেশি জরুরি মানের উন্নয়ন। দেশের চিকিৎসাসেবা উন্নত হলে এ দেশে সেবা নিতে বিদেশিরা আসতো। এতে সেবা রপ্তানি বাড়তো। এখন তার উল্টো হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা নিতে দেশের মানুষকে বিদেশে যেতে হচ্ছে। আর তাতে সেবা রপ্তানির পরিবর্তে আমদানি করা হচ্ছে। সেবা রপ্তানিতে ব্যবসায়িক স্বার্থে বেসরকারি খাতকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে সেবা রপ্তানিতে খুব বেশি কিছু করার নেই।
অথচ সার্ভিস ওয়েভারের আওতায় বিভিন্ন দেশে সহজে সেবা রপ্তানির সুযোগ ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি, হিসাব পেশা, নিরীক্ষা, পর্যটন খাতসহ প্রকৌশলী, স্থপতি, চিকিৎসক, সেবিকা ও আইনজীবীরা বর্তমানের চেয়ে সহজেই আরো বেশি হারে উন্নত দেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পেতেন। সেবা রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে ব্যবহার করা, সেবার মান উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ও অবকাঠামোর মতো বিষয়ে মনোযোগ জরুরি। মূলত সেবার নিম্নমানের কারণেই সেবা রপ্তানির সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সেবা খাতের অবদান ছিল ৫১ শতাংশ। আগের বছরগুলোতে এ হার আরো কিছুটা বেশি ছিল। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে মোট ১ হাজার ১২৪টি বিনিয়োগ প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশিই সেবা খাতের। অন্যদিকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাবের ৪৩ শতাংশই সেবা খাতে। আর ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত অর্থবছরে ১০ মাসে সেবা রপ্তানি খাতে সবেচেয়ে বেশি আয় এসেছে পরিবহন সেবা থেকে, ৯২ কোটি ডলার। সমুদ্র, বিমান, রেল ও সড়ক পরিবহন থেকে এই আয় আসে। অফিস মেনটেইন্যান্স থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯০ কোটি ডলার এবং নির্মাণ থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৪ কোটি ডলার এসেছে। এছাড়া বড় খাতের মধ্যে টেলিযোগাযোগ সেবা থেকে ৫৬ কোটি ডলার এসেছে। বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার সার্ভিস রপ্তানি থেকে এসেছে ৪৬ কোটি ডলার। ভ্রমণ থেকে এসেছে ৩৭ কোটি ডলার।
এ বিষয়ে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান জানান, অতিমারি করোনাকালে বৈশ্বিক পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে ২০২০-২১ অর্থবছর পরিবহন সেবা রপ্তানি থেকে ভালো আয় সম্ভব হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এ খাতের বর্ধিত আয় আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। সেবা রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ নিম্নমান। সেবার মান বিশ্বমানের না হওয়ায় রপ্তানি সে হারে বাড়ছে না। তবে মান বাড়াতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার ভিত্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ফলে আগামীতে মানের সংকট হয়তো কেটে যাবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ