এম. মছব্বির আলী, মৌলভীবাজার:
মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর স্বীকৃতি নিয়ে মরতে চান মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সরিফা বেগম (৫০)। সম্মুখ সমরে জীবন বাজি রেখে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করলেও তাঁর স্বামী মৃত মো. রমিজ উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্ণেল আতাউল গণী ওসমানী ও ৪ নম্বর সেক্টরের আঞ্চলিক অধিনায়ক চিত্তরঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) স্বাক্ষরিত একটি ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র’ পেলেও যার কোন মূল্য পাননি তিনি। প্রায় পাঁচ বছর আগে মারা যান তিনি। এখন তাঁর অসহায় স্ত্রী সরিফা বেগমের আকুতি স্বামীর জীবদ্দশায় না পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া দেখে মরতে চান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুলাউড়া পৌরসভার জয়পাশা এলাকার বাসিন্দা মৃত মুনশী মিয়ার ছেলে রমিজ উদ্দিন। ১৯৫০ সালের ১০ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার সি.আর দত্তের নেতৃত্বে কুলাউড়া ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেন। স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রস্তুত কালে রমিজ উদ্দিন এলাকায় না থাকার কারণে তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গেজেটভুক্ত হয়নি। পরবর্তীতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গেজেটভুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন জীবিত থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবরে একটি আবেদন করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন ফরম পূরণ করেন। আবেদনের ডিজি নং- ডিজি ১২১৮৭৭৯)। জীবিত থাকাবস্থায় প্রথমদিকে তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গেজেটভুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করে গেছেন। এরপর গত ২০১৭ সালের ২২ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন মারা যান। রমিজ উদ্দিন ভারতের কৈলাশহরের লোহারবন্দে এস.এল.আর ব্রি নট্ ত্রি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ১৯৭১ এর ২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কমলগঞ্জের আলীনগর, শমসেরনগর ও পাথরখলা এলাকায় বিএল এফ বাহিনীর অধীনে দিনব্যাপী তুমুল লড়াই করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর তিনজন সহযোদ্ধা হলেন শরীফপুর ইউনিয়নের নমুজা গ্রামের মো. সুন্দর আলী, আলকাছ মিয়া ও মো. সফর আলী। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিনের কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন আব্দুল মুহিত চৌধুরী।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুলাউড়া পৌর শহরের জয়পাশা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিনের বাড়িতে বসবাস করছেন তাঁর স্ত্রী সরিফা বেগম ও দুই সন্তান। ছেলে শেখ রাকিব আলী (৮) স্থানীয় আমীর ছলফু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ও মেয়ে সাবিহা আক্তার পলি (১৫) কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছেন। রমিজ উদ্দিনের বসতঘরের অবস্থায় খুবই জীর্ণশীর্ণ। রান্নাঘরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতর পানি পড়ে। এমন জরাজীর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিনের স্ত্রী সরিফা বেগম বলেন, আমার স্বামী মৃত্যুকালে শেষ সম্বল হিসেবে কিছুই রেখে যেতে পারেন নি। উনার শেষ ইচ্ছা ছিলো, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্তি। স্বামী মারা যাওয়ার ৭ মাস আগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আর তালিকায় নাম যুক্ত হয়নি। সময় এবং ভাগ্য উনার সহায় ছিলো না। উনি যে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন সেই দেশে উনাকে রাষ্ট্রীয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি টা দেয়া হোক। স্বীকৃতি না পাওয়ার যে আক্ষেপ নিয়ে উনি মৃত্যুবরণ করেছেন সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে আমাদের এই চাওয়া। স্বীকৃতিটা পেলে হয়তো ওপারে থেকেও উনার আত্মা শান্তি পাবে। তিনি আরো বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর বড় অসহায় হয়ে পড়ি। কেউ আমাদের কোন সহযোগিতা করেনি। বাড়িতে মাত্র দেড়শতক জায়গায় দুই সন্তানদের নিয়ে কোনমতে বসবাস করছি। মানুষের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা সম্মানী পেয়ে কোনরকম পরিবার চালাচ্ছি। তাছাড়া ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ যোগাতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়। সরকার কিংবা প্রশাসন যেন আমাদের দিকে একটু দৃষ্টি রাখেন এই কামনা করি।
কুলাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সুশীল চন্দ্র দে বলেন, তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া কাউকে আমরা স্বীকৃতি দিতে পারিনা। উনার পরিবার তালিকাভুক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। নতুন তালিকাভুক্তির আবেদন জুলাই মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে সুযোগ তৈরি হলে উনার আবেদন যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুর রহমান খোন্দকার বলেন, মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের বিষয়ে খোঁজ নিবো। পরবর্তীতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন পাঠানো হবে। আর ওই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে একটি ঘর দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি