November 15, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, January 23rd, 2022, 8:51 pm

সড়কে বাড়ছে লাইসেন্সহীন চালক, আর ফিটনেসহীন গাড়ি

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সড়ক নিয়ন্ত্রণে আইন আছে, কিন্তু সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। আইনের এই প্রয়োগহীনতার সংস্কৃতির ফলে দেশ মুখোমুখি হচ্ছে অপূরণীয় ক্ষতির। দেশের অনেক সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাদীপ্ত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে সড়ক বিশৃঙ্খলার কারণে। তাঁদের মৃত্যুতে তাঁদেরকে ঘিরে আবর্তিত অনেক জীবন পড়ে যাচ্ছে বিপাকে। সড়কে এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর মিছিল দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের টনক নড়ছে না।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত ৭ হাজার ৪৬৮ জন। যা বিগত দুই বছরের তুলনায় অনেক বেশি। শেষ বছরের দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। যা জিডিপির দশমিক ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন। আর আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেশি। অবস্থা যা, তাতে ২০২০ সালের হিসাব ২০১৯ সালের চেয়ে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। সড়ক-মহাসড়কে অপমৃত্যুর এই স্থায়ী বন্দোবস্তই যেন বাংলাদেশে ‘নতুন স্বাভাবিকতা’। এটাই যেন অলঙ্ঘনীয় নিয়তি। বছর যায়, দশক যায়, কিন্তু সড়কে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় সত্যিই কিছু করা হয় না। সরকারি বয়ান যত গর্জে তত বর্ষে না। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার কিশোরেরা সহপাঠীর মৃত্যুতে রাস্তায় নেমে অভূতপূর্ব আন্দোলন করেছিল। জাতির বিবেককে ঝাঁকুনি দিয়েছিল সেই আন্দোলন। সমাজে ব্যাপক আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো টনক নড়েনি। এত মৃত্যু, এত কান্না, এত আন্দোলন, এত আবেদন-নিবেদনের পরও যে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে, তা সংকটের মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। বলা যায়, সংঘবদ্ধ শ্রমিক-মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে পথচলাই যেন জীবন এখন। কিছুদিন আগেও দীর্ঘ সময় ব্যাপী প্রতিবাদ, অনশন হয়ে গেলো। কিন্তু সড়কের চিত্র বদলে যায়নি। সড়কের অবস্থা সেই থোড় বড়ি থোড়া, থোড়া বড়ি থোড়।
বর্তমানে দেশে বাইক রাইড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে অনেকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। গত বছর সবচেয়ে বেশি হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ৫ হাজার ৩৭১টি দুর্ঘটনার মধ্যে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।
এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন। যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২১ দশমিক ১২ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, মোটরসাইকেলে ভারী যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ। ৪০ দশমিক ৭৬ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল চালক এককভাবে দায়ী ছিল।
এছাড়া জানা যায়, দুর্ঘটনার জন্য বাসের চালক দায়ী ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ, ট্রাকচালক দায়ী ২৮ দশমিক ০৫ শতাংশ, কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ট্যাংকার চালক দায়ী ৯ শতাংশ, প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাস চালক ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, থ্রি-হুইলার ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বাইসাইকেল, প্যাডেল রিকশা, রিকশাভ্যান চালক দায়ী শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং পথচারী দায়ী ৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে, ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে, ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ ঘটেছে গ্রামীণ সড়কে এবং ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে শহরের সড়কে।
সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ হলো চালকদের অদক্ষতা। চালকদের গোঁয়ার্তুমিও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। রাস্তায় নামলেই তাঁদেরকে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। এতে তাঁরাও মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দুর্ঘটনায় যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৯৮ জন (১২.৬৯ শতাংশ)। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ২৬৬ জন চালক নিহত হয়েছে। যা তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট নিহতের ২৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে এক হাজার ১৯০ জন চালক নিহত হয়। যা মোট নিহতের ২২ শতাংশ।
বাংলাদেশের সড়ক এমনিতেই খুব একটা প্রশস্ত নয়। এসব স্বল্প প্রশস্ত সড়কে চলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এই গাড়িগুলোই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বেশি। জানা যায়, দেশে লাইসেন্সবিহীন ২৪ লাখ চালক গাড়ি চালাচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ অদক্ষ চালক বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানসহ ভারী যানবাহন চালাচ্ছে। হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিয়ে অনেকে ভারী গাড়ি চালাচ্ছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো হচ্ছে। অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স নেই। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। অসংখ্য চালকও নিহত হচ্ছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সড়কে যে পরিবহণগুলো চলাচল করে সেগুলোর অধিকাংশরই নিবন্ধন করা নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৮টি। বেসরকারি হিসাবে-সড়ক-মহাসড়কে নিবন্ধিত গাড়ির বাইরে ফিটনেসবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ আরও কয়েক লাখ গাড়ি চলাচল করে। আসলে এর সঠিক হিসাব কোনো সংস্থার কাছে নেই। নিসচার হিসাব অনুযায়ী, ২৪ লাখ লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক গাড়ি চালাচ্ছে। অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। বেশির ভাগ চালক ওস্তাদের কাছ থেকে শিখে রাস্তায় নেমেছে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যান বলছে- সারা দেশে ৮৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গতি। ভুল ওভারটেকিংয়ের কারণে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।
সড়ক দুর্ঘটনায় যে শুধু মানবজীবনের ক্ষতি হয় তা নয়, ক্ষতি হয় মানবসম্পদেরও। জানা যায়, গত বছরের সড়ক দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের ক্ষতির আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। এটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের হিসাবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি এর চেয়েও ৪-৫ গুণ বেশি। কারণ দুর্ঘটনার অনেক খবরই রিপোর্টেড হয় না। এই হিসেবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আমাদের জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ হতে পারে। এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৯২ জন (৮২ দশমিক ৬২ শতাংশ)।
একটি জিনিস স্পষ্ট যে, প্রতিবার দুর্ঘটনার পর পরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনদিন আলোর মুখ দেখে না। আর সঙ্গত কারণেই দোষীদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ- যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন কোন একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। এই বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা মহামারীর মতো বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।