এম. মছব্বির আলী, মৌলভীবাজার:
কবিতা (৭)। সে কুলাউড়া পৌর শহরের অংকুর কিন্ডার গার্টেনে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। তার খুব শখ হোটেলে বসে সহপাঠীদের সাথে একত্রে খাবার খাওয়ার। কিন্তু সে হরিজন সম্প্রদায়ের সন্তান বলে তাকে হোটেল বসে খেতে দেওয়া হয়না। হোটেলের বাইরে কাগজের ওপর খাবার নিয়ে কবিতাকে হোটেলের বাইরে বসতে হয়। তারমতো কুলাউড়া পৌর শহরের রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর ছাত্র বিশাল (১২), ৩য় শ্রেণীর ছাত্র রনবীর (১১), রেলওয়ে জুনিয়র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র সঞ্জয় (১৪), রেলওয়ে জুনিয়র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণীর ছাত্র নীরব (৭), ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী রিমি (১২), ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী নন্দিনী (১৩), বিএইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর ছাত্র বিরাট (১১)। তারা সবাই কুলাউড়া পৌর শহরের পরিনগর রেলওয়ে হরিজন কলোনীতে বসবাস করেন এবং হরিজন সম্প্রদায়ের সন্তান।
তারা জানায়, স্কুলের টিফিনের সময় বা ছুটির সময় হোটেলে বসে খেতে পারেন না। তাদের বন্ধু/বান্ধব একই সাথে এসে হোটেলে প্রবেশ করলেও তারা সেটা পারেন না। তাদের খুব ইচ্ছা হোটেলে বসে সহপাঠিদের সাথে খাবার খাওয়ার। কিন্তু তাদের হোটেলে বসতে দেওয়া হয় না হরিজনের সন্তান বলে। তাদের কাগজে বা আলাদা নিজস্ব পাত্রে খাবার দিয়ে হোটেলের বাইরে বসতে হয়। হরিজনের সন্তান হওয়াটাই তাদের অপরাধ।
অভিযোগ উঠেছে, মূল স্রুতের সাথে বসে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনসহ স্কুলে পড়ুয়া তাদের ছেলে মেয়েদের হোটেলে খেতে দেয়া হয়না। এমনকি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে। হোটেলের বাইরে তাদের নিজস্ব পাত্রে খেতে দেয়া হয়।
হরিজন সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতের অভিযোগ এনে প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। যার অনুলিপি জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজার, চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদ, মেয়র, কুলাউড়া পৌরসভা ও অফিসার ইনচার্জ কুলাউড়া থানাকে প্রেরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের কুলাউড়া শাখার সভাপতি মৎলা বাসপর অভিযোগ করে বলেন, আমরা হরিজন সম্প্রদায় এসব সামাজিক বা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা শহরের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করি। আমাদের ছেলে মেয়ে শহরের বিভিন্ন স্কুলে পড়ালেখা করে। কিন্ত স্কুল টিফিন এর সময়ে অন্যান্য ধর্মের বাচ্চারা হোটেলে ভিতরে বসে খায় কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েরা স্কুল ড্রেস পরে গেলেও তাদেরকে কাগজে নাস্তা দেওয়া হয় এবং ময়লা পাত্রে পানি দেয়। যা দেখে স্কুলে অন্যান্য সহপাঠিরা তাদের সাথে মিশতে চায়না এবং তাদের ঘৃণা করে।
আমরা হরিজন সম্প্রদায় বলে কুলাউড়ার হোটেলগুলোতে আমাদেরতো খেতে দেয় না। এখন দেখি আমাদের শিশুদের সাথেও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। তাই আমরা এর প্রতিবাদ করছি। আমাদের সাথে এমন আচরণ করছে শহরের ইস্টার্ণ, পাকসী, নাজমা ও গোল্ডেন ভিউসহ অন্যান্য হোটেল। কিন্তু দেশের অন্যান্য জেলা বা বিভাগে হরিজন লোকেরা হোটেলে বসে খায়। সেখানে হরিজনদের কোন বাঁধা দেয়া হয়না। কিন্তু কুলাউড়ায় একমাত্র ব্যতিক্রম।
তিনি আরো বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বিভিন্ন ভূমিকা রাখছে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন। হরিজনরা শহরের আনাচে-কানাচে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা করে বলে পরিবেশ সুন্দর থাকে। কিন্তু আমাদের সাথে কেন এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হবে। আমরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি, আমাদের মৌলিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করা হয়।
এদিকে শহরের হোটেল মালিকদের অভিযোগ, হরিজনদের হোটেল থেকে পার্সেল বা হোম ডেলিভারি নিয়মিত দেয়া হয়। কিন্তু হোটেল থাকা অন্যান্য লোকদের খেতে অসুবিধা হওয়ার কারণে তাদের জন্য হোটেলের বাইরে ব্রেঞ্চ দেয়া হয়েছে। অনেক সময় হরিজন সম্প্রদায়ের অনেকেই মদ্যপান করে হোটেল প্রবেশ করেন। তখন তাদের এইসব আচরণের কারণে হোটেলে থাকা অন্যান্য গ্রাহকদের নানা অসুবিধা হয়। অনেক সময় আমাদের গ্রাহকরা হোটেল থেকে চলে যান এতে আর্থিকভাবে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হই।
কুলাউড়া হোটেল মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক মোঃ লোকমান মিয়া বলেন, আমাদের মধ্য কোন বৈষম্য নেই। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি ব্যবসা করবো। হরিজনদের দাবি, তারা হোটেলে সবার সাথে বসে খেতে চায় কিন্তু হোটেলে থাকা অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদের রয়েছে আপত্তি। তবে স্কুলে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের হোটেলে না খাওয়ানোর বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে হরিজনদের হোটেলে কিভাবে খাবার পরিবেশন করা হবে সেটা তাদের সাথে আলোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্য সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ মেহেদী হাসান বলেন, আমি একটি হোটেল পরিদর্শনও করেছি ও হোটেল মালিককে বলেছি যে, সংবিধান বা আইনের কোন জায়গায় কি এমন কথা আছে কিনা যে হরিজন বা পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সাথে একত্রে বসে খাওয়া যাবে না। তাই সবাইকে বলেছি এভাবে কোন জাতিকে বৈষম্য করা যাবে না। আজকের মধ্যে হোটেল মালিকরা বিষয়টি সমাধান করবেন বলে আমাদের কাছ থেকে সময় নিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ মাহমুদুর রহমান খোন্দকার বলেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের হোটেল একসাথে বসে খেতে পারবে। এতে কোন বাঁধা নেই, এখানে কোন জাতিকে হেয় করে দেখা চলবেনা। হরিজনদের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর হোটেল মালিকদের ডেকেছি, তখন তাদের নির্দেশনা দিয়েছি, কাউকে হেয় না করে সুন্দর পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য। এরপরও যদি কোন হোটেল মালিক ফের হরিজনদের সাথে এই ধরণের আচরণ করেন তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি