মনোমুগ্ধকর বর্ণনা ও নজরকাড়া ভিজ্যুয়াল দিয়ে দর্শকদের বিমোহিত করার জন্যই সিনেমা ও সিরিজ তৈরি করা হয়। আর টিজার ও ট্রেইলারের মাধ্যমে দর্শকেরা এই বিনোদনমূলক কন্টেন্টের প্রথম জমজমাট দেখা পায়। হলিউডে টিজার ও ট্রেইলার তৈরি শিল্পটি উল্লেখযোগ্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একজন তরুণ বাংলাদেশি, বর্তমানে হলিউডে এই তুলনামূলকভাবে অজানা কিন্তু বৃহৎ শিল্পের একজন গর্বিত সদস্য।
মানসম্মত টিজার ও ট্রেলার তৈরি করে বৈশ্বিক সীমানা পেরিয়ে জিসান কামরুল হাসান নামের একজন বাংলাদেশি তরুণ হলিউডে মোশন গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয় কিছু সিনেমা ও সিরিজের টিজার ও ট্রেলারে তার কাজের মাধ্যমে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
মার্ভেল স্টুডিও’র সাম্প্রতিক গ্রাফিক-ইনটেনসিভ হিট ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস’ থেকে ‘লাস্ট নাইট ইন সোহো’ সমালোচকদের দ্বারাও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের কুমিল্লার লাকসাম থেকে জিসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসের কালভার সিটিতে গিয়ে নিজের লক্ষ্য পূরণে দীর্ঘ-কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন।
দেশের একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশের পর জিসানের নাম বিনোদন অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে এবং নেটিজেনরাও হলিউডে জিসানের যাত্রা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
হলিউড থেকে ইউএনবির সঙ্গে একান্ত আলাপকালে জিসান বলেন, ‘আসলে ২০০২ সালে খুব অল্প বয়সে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল। যখন আমি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ফিল্ম ‘লর্ড অব দ্য রিংস’-এর জাঁকজমকপূর্ণ ভিজ্যুয়াল দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি মোশন গ্রাফিক্স সম্পর্কে আশ্চর্য হয়েছিলাম এবং তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি এটা শিখব।’
২০০২ সালে স্বপ্ন দেখলেও জিসান ২০০৭ সালে তার প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটার পেয়েছিলেন। এরপর ২০০৮ তিনি সালে ঢাকায় চলে আসেন এবং ইউটিউব দেখে নিজে থেকে ফটোশপ প্রাকটিস শুরু করেন। থ্রিডি অ্যানিমেশন ও মোশন গ্রাফিক্সের প্রতি তার আগ্রহ এবং আগে থেকে চর্চার জন্য তিনি ঢাকার আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এইউএসটি) থেকে সিএসইতে স্নাতক পড়ার সুযোগ পান।
তিনি বলেন, ‘আমি সেই সময়ে গ্রাফিক ডিজাইন ও ফটোগ্রাফি থেকে অর্থ উপার্জন শুরু করেছি, এসময় আমি প্রথম মোশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব পাই। ২০১২ সালে একদিন আমার মেসের এক রুমমেটের এক সিনিয়র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন যে আমি গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে তার ব্যবসার জন্য কাজ করতে আগ্রহী কিনা।’
জিসান স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘২০১৩ সালে আমি আমার ক্যামেরা কিনি এবং ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ফটোগ্রাফি শুরু করি। আমার জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন দেখি। সেসময় আমি কিছু শর্ট ফিল্ম বানাই, ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতাম, একঝাঁক সৃজনশীল ও প্রতিভাবান বন্ধুদের সঙ্গে মিশতাম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ‘ছবির হাট’-এ নিয়মিত ও ঘন ঘন যেতাম।’
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জিসান বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে চলে যান এবং কাজী শামসুল হক নামের একজন প্রবাসী সাংবাদিকের সহায়তায় একটি পত্রিকায় গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন।
জিসান ইউএনবিকে বলেন, ‘আমি জানতাম না, আমার আসল সংগ্রাম মাত্র শুরু হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৭ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে চলে আসি। প্রথম বছর আমাকে খুব হিসেব করে চলতে হয়েছিল। একটা বড় ও সম্পূর্ণ নতুন শহর, বেশ ব্যয়বহুল পরিবেশ এবং বিভিন্ন ধরনের কয়েক হাজার সমস্যা। তবু আমি টিকে ছিলাম, কিন্তু তারপরে কোভিড-১৯ আঘাত হানে এবং আমি বুঝতে পারি যে সবকিছু একপাশে রেখে আমাকে আমার লক্ষ্যে সফল হওয়ার চূড়ান্ত চেষ্টাটা করতে হবে।’
জিসান ইউএনবিকে বলেন, ‘এটি আমার জন্য ‘হয় এখন নাহলে আর কখনোই না’ পরিস্থিতি ছিল। তাই আমি আমার সবকিছু দিয়ে এই কাজটা শুরু করি। আমি আমার চাকরি ছেড়ে দেই, ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখতে শুরু করি, আর্টিকেল ও বই পড়ি, সিনেমার মূল্যায়ন দেখি এবং নতুন সফ্টওয়্যার যেমন আফটার ইফেক্টস, ফোর ডি সিনেমা, হাউডিনি ও নিউকে শিখতে শুরু করি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ১৫-১৮ ঘণ্টা এই রুটিনটা অব্যাহত ছিল। একজন নবাগত হিসেবে এটা আমার জন্য অকল্পনীয়ভাবে কঠিন ছিল, কিন্তু আমি আমার জীবনের অনেক রাতের ঘুম ও অন্যান্য বিলাসিতাকে ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে এটা করেছি।’
তারপরে তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেই বছরের মে পর্যন্ত তার শোরিল/পোর্টফোলিও তৈরি করেন। তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবারের সঙ্গে ঈদুল আজহার ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে আসার পর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত অল্পদিনের জন্য বিরতি নেন। তিনি আগস্টে লস অ্যাঞ্জেলসে ফিরে যান এবং চাকরির জন্য আবেদন করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘হলিউড একটি তুমুল প্রতিযোগিতামূলক জায়গা, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিভাবান মানুষ একটি সুযোগের জন্য আসেন। এই রেসের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পর আমি মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইনার পদের জন্য প্রতিদিন ৩০-৪০টি প্রোডাকশন কোম্পানিতে আমার শোরিল/পোর্টফোলিও পাঠাতে শুরু করি।’
জিসান বলে চলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, আমি খুব বেশি ইন্টারভিউ কল পাচ্ছিলাম না। এমনকি আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক পরিচালক ও প্রযোজকদের কাছে আমার শোরিল/পোর্টফোলিও পাঠিয়েছিলাম এবং অবশেষে তিন মাস পর আমার বর্তমান নিয়োগকর্তা ওয়াইল্ড কার্ড ক্রিয়েটিভ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমাকে নির্বাচন করেন। আমি ২০২১ সালের নভেম্বরে এখানে যোগ দিয়েছি।’
জিসানের ট্রেইলার তৈরি করার প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল ‘লাস্ট নাইট ইন সোহো’ চলচ্চিত্রের জন্য, তবে তিনি ‘হাউস অব গুচি’-এর ক্লিপটিকে তার প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ বলে মনে করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত কিংবদন্তি স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত ‘দ্য ব্যাটম্যান’, ‘মরবিয়াস’, ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস’ ও ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’-র মতো বড় চলচ্চিত্রগুলোতে নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
এই সিনেমাগুলো ছাড়াও, তিনি ‘বসচ: লিগ্যাসি’, ‘তেহরান’ (সিজন ২), ‘দ্য কারদাশিয়ানস’ সহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি টেলিভিশন ডকুসিরিজেও কাজ করেছেন।
জিসান ইউএনবিকে বলেন, ‘আমরা যে টিজার ও ট্রেইলার তৈরি করি আমরা আমাদের প্রযোজনায় থিয়েটার ও টেলিভিশন ছাড়াও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব ও স্ন্যাপচ্যাটসহ প্রধান সামাজিক মাধ্যমসমূহেও সরবরাহ করি।
ইন্ডাস্ট্রি ও ট্রেইলারের বাজার সম্পর্কে জিসান বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে একটি বহু-বিলিয়ন ডলারের শিল্প, কারণ টিজার-ট্রেইলার হল দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর প্রথম গেটওয়ে। আমরা যে দুটি ধরনের ট্রেলার তৈরি করি- দেশীয় (মার্কিন) দর্শকদের জন্য এবং অন্য সংস্করণটি আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য। তাছাড়া সিনেমা ও সিরিজের দর্শক আলাদা, তবে আমরা যদি গত ছয় মাসের ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষণ করি-আমরা দেখতে পাই আরও বেশি সংখ্যক স্ট্রিমিং সাইট আসার ও বিকাশ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সিরিজ ও ডকুসিরিজের দর্শকও বাড়ছে।’
যখন তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রির প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা বা সুবিধাগুলোকে তুলনা করতে বলা হলে জিসান বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রযুক্তিকে বাধা বলে মনে করি না। কারণ আমি বাংলাদেশেও একই রকম বা প্রায় এর কাছাকাছি ধরনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেখেছি। এই শিল্পে ডেডিকেশন ও কঠোর পরিশ্রম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটা মানসম্পন্ন কাজ করার আগে আমি ২০০ বার পর্যন্ত একটি ট্রেইলার তৈরি করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি দেখেছি কিভাবে আমাদের কোম্পানির সহযোগী ও সহকর্মীরা তাদের গাইডলাইন দিয়ে কাজের মানসিকতাকে অনুপ্রাণিত ও উন্নত করতে পারে। বিশেষ করে সিনিয়র সহকর্মী ও প্রযোজকরা; তাদের কয়েক দশকের সফল ক্যারিয়ার থাকার পরেও নিয়মিত তারা টিউটোরিয়াল ও পাঠের মাধ্যমে তাদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটান। আমার সহকর্মীরা আন্তরিক ও সহায়ক; আমি যখনই নতুন কিছু করার চেষ্টা করি, তারা কখনোই আমাকে নিরুৎসাহিত করেনি।’
যেহেতু জিসান বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন এবং কিছুদিনের জন্য এখানকার বিনোদন ও সৃজনশীল শিল্পে কাজ করেছেন, তাই তিনি দেশের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ভালভাবে জানেন।
তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ও সিরিজ দেখি; অর্চিতা স্পর্শিয়া অভিনীত ২০১৯ সালের ছবি ‘কাঠবিড়ালি’ আমার পছন্দের একটি। আমি ‘হাওয়া’ সহ সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ও সমাদৃত চলচ্চিত্রগুলোর ট্রেইলারগুলোও দেখেছি এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমরা যদি আগামী দিনে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ চালিয়ে যাই, তবে আমাদের গৌরবময় অতীতের মতো এই শিল্প আবারও সমৃদ্ধ হবে।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জিসানের বিশেষ অনুরাগ রয়েছে। তার নিজের মামা শহীদ ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। জিসান মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ইচ্ছা পোষণ করেন।
জিসান বলেন, ‘আমি আমার পেশা ছাড়ব না, কারণ এই পেশার জন্য আমি দিনরাত সংগ্রাম করেছি এবং আমার গভীর স্বপ্ন আছে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার। তবে, এটা তখনই সম্ভব হবে যদি আমি আমার গল্প বলার জন্য উপযুক্ত সৃজনশীল স্বাধীনতা ও বাজেট পাই।’
একজন গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবে তার দৃঢ়তা ও কষ্টের মাধ্যমে হলিউডের মূলধারার বিনোদন শিল্পে স্থান করে নেয়া জিসান হলিউডে আরও বাংলাদেশি সহকর্মীদের দেখতে চান।
জিসান কামরুল হাসান ইউএনবিকে বলেন, ‘৩২ বছর বয়সে এসে আমি অবশেষে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি আমার বাকি জীবন কী করতে চাই। এই কাজটা আমার নিজের কাছে নিজের সারাজীবনের প্রতিশ্রুতি এবং আমি আগামী বছরগুলোতে নিজেকে একজন সফল শিল্প পরিচালক হিসেবে দেখতে চাই।’
—-ইউএনবি
আরও পড়ুন
মা হারালেন চিত্রনায়িকা পূজা চেরি
প্রকাশ্যে এলো শাকিবের ‘‘রাজকুমার’-এর ফার্স্টলুক
এবারের ঈদে প্রেক্ষাগৃহে বুবলীর দুই সিনেমা