এম. মছব্বির আলী, (হাকালুকি হাওর থেকে ফিরে) :
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাওর ও দেশের অন্যতম মৎস্যভান্ডার খ্যাত হাকালুকি হাওরে দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। হাকালুকিতে ১০৭ প্রজাতির দেশীয় মাছ থেকে বর্তমানে ৪৪ প্রজাতি-ই বিলুপ্ত। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন, প্রজননের সময় অবাধে মৎস্য শিকার, অভয়াশ্রমের অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে বিলুপ্ত হয়ে এসব দেশীয় মাছ। জেলা মৎস্য অধিদপ্তর ও হাওরের প্রতিবশে এবং জীব বৈচিত্র নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কাজ করা বেসরকারি এনজিও সংস্থার তথ্যমতে, দেশের মৎস্যভান্ডার খ্যাত হাকালুকিতে সরকারি ২৩৮ ও বেসরকারী বিল রয়েছে ৩৮টি। এ হাওরে ১০৭ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিলো। যা বিলুপ্ত হতে হতে বর্তমানে ৬৩টি প্রজাতির দেশীয় মাছ রয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় ৪৪ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্যতম হলো চিতল, পাবদা, রানী মাছ, গাঙ মাগুর, আইড়, চাপচেলা, মেনী মাছ, বাঁশপাতা, গুজি আইড়, দেশী সরপুঁটি, ফেনী মাছ, বাতাসি, বাঁশাপতাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় সুস্বাদু মাছ।
প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন, অবাধে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে পোনা মাছসহ মৎস্য শিকার, পর্যাপ্ত অভয়াশ্রম না থাকা, উজান ঢলের পানিতে নেমে আসা পলি মাটিতে বিল ভরাট, হাওরে বোরো ধান ও সবজি চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অধিক ব্যবহারে এসব দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এছাড়াও মাছের প্রজনন সময়ে সংরক্ষণ ও মৎস্য শিকার বন্ধের উদ্যোগ না নেওয়া অন্যতম একটি কারণ। কাগজেপত্রে ১১টি অভয়াশ্রম থাকলেও বিশাল হাওরে অভয়াশ্রম বিল হিসেবে কৈয়ারকোনা, মৈইয়াজুড়ী ও কাংলী-গোবরকুড়ি এ তিনটি কার্য্যকর রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাকালুকি নির্ভর মৎস্যজীবি পরিবার রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার। এ হাওরেই মাছ শিকার করে জীবিকা চলে মৎস্যজীবিদের। বর্ষা মৌসুমে মার্চ মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত মাছের প্রজননের সময়ও মৎস্য শিকারে কোন বিধি নিষেধ না থাকায় দরিদ্র মৎস্যজীবিদের ব্যবহার করে একটি চক্র হাওরে বিভিন্ন নিষিদ্ধ জাল দিয়ে অবাধে ছোট বড় পোনামাছ ও মা মাছ শিকারে লিপ্ত থাকে। তাছাড়া মৎস্যজীবিদের নাম ব্যবহার করে সমিতির নামে ইজারাদাররা বিল লিজ নেয়। এসব লিজকৃত বিলে শুধুমাত্র জাল দিয়ে মাছ শিকারের শর্ত থাকলেও ইজারাদার বিধি নিষেধকে উপেক্ষা করে সেচ দিয়ে বিলের পানি কমিয়ে মাছ শিকার করেন। এদিকে অনেক বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে পানি না থাকায় মাছের আশ্রয়স্থল সংকট রয়েছে।
ইউএসইডের সহায়তায় সিএনআরএসের আওতায় হাকালুকির প্রতিবশে প্রকল্পের সাইট কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান জানান, মাছের প্রজনন সময় হাওরে মাছ শিকারে বিধি নিষেধ থাকলে এবং ওই সময় জেলেদের মাছ শিকারে নিরোৎসাহিত করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হলে মাছের বংশ বিস্তার বৃদ্ধি পাবে। অভয়াশ্রমগুলো পুরোপরি কার্যকর, জলজ বনগুলোও সংরক্ষণ এবং বৃদ্ধি করা হলেও মাছের উৎপাদন বাড়বে। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে অনেক দেশীয় মাছ-ই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক (ইলিশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ) সুলতান মাহমুদ মোবাইলে জানান, হাওর অঞ্চলের দেশীয় মৎস্য সম্পদ রক্ষায় একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মাছের প্রজননের সময় হাওরে মাছ শিকারে বিধি নিষেধ আরোপ, ওই সময় হাওর নির্ভর জেলেদের সহায়তা প্রদান করে মাছ শিকারে নিরোৎসাহিত এবং দেশীয় প্রজাতি পোনা অবমুক্ত ও অভয়াশ্রম বৃদ্ধি করা যাবে।
মৎস্য অধিদপ্তর মৌলভীজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মুহম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, মৎস্য অধিদপ্তর থেকে হাকালুকিসহ দেশের বিভিন্ন হাওরের মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ‘ইলিশ সংরক্ষণ প্রকল্পের’মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে। ওই দলটি ইতোমধ্যে হাকালুকি হাওর পরিদর্শন করে গেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মাছের প্রজননের সময় বিধি নিষেধের আরোপসহ নানা কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া যাবে। অভয়াশ্রমগুলোকে পুরোপুরি কার্যকরী করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে হাকালুকির কৈয়ারকোনা বিলকে আদর্শ অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলমান রয়েছে।
আরও পড়ুন
এলডিসি গ্রাজুয়েশনে বাংলাদেশের সুষ্ঠু উত্তরণে পূর্ণ সহায়তার আশ্বাস জাতিসংঘের
জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা নিয়ে ইউনূস-আইসিসির আলোচনা
দেশ সংস্কারে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র