অনলাইন ডেস্ক :
বিরোধী মতের মানুষকে গুম করে ফেলার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানে বিতর্ক চলছে। দেশটির জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সন্দেহের আঙুল তুলছেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার দিকে। রাওয়ালপিন্ডির এরিড এগ্রিকালচার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফিরোজ বালোচ গত ১১ মে পড়াশোনার জন্য বইপত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির দিকে রওয়ানা হন। কিন্তু এরপর তিনি আর ফেরেননি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনো খোঁজ মেলেনি বেলুচিস্তান থেকে আসা ছাত্র ফিরোজের। সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিরে না আসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা তার রুমমেট এবং চাচাতো ভাই রহিম বালোচ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ ফিরোজ সাধারণত সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসেন।‘‘আমি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ পাঠালাম। কিন্তু মেসেজটি পৌঁছেনি। তারপর তাকে আমি ফোন কররাম, দেখলাম তার ফোন বন্ধ। ভাবলাম তার ফোনে হয়তো চার্জ ফুরিয়ে গেছে। অপেক্ষা করতে লাগলাম- সে ফিরে আসবে।”সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফিরোজ ফিরছেন না। উদ্বিগ্ন রহিম রাতে বালোচিস্তানের তুরবাতে তার বন্ধুর পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগলেন। হয়তো ফিরোজ নিজ বাড়িতে গেছেন সেই আশায়। কিন্তু অনেক রাত, তাই বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। যে কারণে ফেরোজের পরিবারের যোগাযোগ করতে পারেননি রহিম।‘‘সারারাত জেগে রইলাম। কিন্তু ফিরোজ ফিরেনি। পরদিন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানালাম যে ফিরোজের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিল না,” বলেন রহিম।উদ্বিগ্ন রহিম তখন পুলিশ স্টেশনে গিয়ে অভিযোগ জানাতে চাইলেন। কিন্তু পুলিশ কোনো অভিযোগ নিতে রাজি নয় পুলিশ, রক্ত সম্পর্কের কেউ ছাড়া নাকি অভিযোগ জমা নেবে না পুলিশ।ফিরোজের বাবা নুর বক্স বেলুচিস্তান পুলিশ স্টেশনে কর্মরত। পরদিন স্থানীয় থানার একটি অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।পাকিস্তানে এভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের তালিকা অনেক লম্বা। ২০০০ সালের সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় আসার পর এভাবে নিখোঁজ হওয়া মানুষের তালিকা লম্বা হতে থাকে। আর নিখোঁজ হওয়া এসকল মানুষদের বেশিরভাগই বেলুচ ও পশতুন জাতিগোষ্ঠীর। এমন প্রেক্ষিতে সরকার ২০১১ সালে কমশন অব ইনকোয়ারি অ্যান্ড এনফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্স নামে একটি সংস্থা গঠন করে।সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাসে সারাদেশে ৮ হাজার ৬৯৬টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ৬ হাজার ৫১৩টি ঘটনার সমাধান করা হয়েছে আর বাকী ২ হাজার ২১৯টি ঘটনার তদন্ত চলছে।
পরিসংখ্যানের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি?
ইসলামাবাদে কর্মরত পাকিস্তানি সাংবাদিক গওহর মেহসুদের মতে, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে দেওয়া সরকারের যে তথ্য তার তুলনায় প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি।তার মতে, কমিশন অব ইনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্স ২০১১ সালে গঠিত হয়। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার এমন ঘটনা তারও এক দশক আগে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে হয়ে আসছে। তাছাড়া বালোচিস্তান, খাইবার পাখতুন ওবং সিন্ধ প্রদেশের মানুষেরা নিখোঁজের বিষয়ে সবসময় কমিশনকে তথ্যও দিতে পারেন না। এদিকে দেশে নিখোঁজ হওয়া লোকের সংখ্যার বিষয়ে আলাদা আলাদা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পশতুন প্রদেশের পশতুন তাগাফুজ মুভমেন্টের (পিটিএম) নামে একটি সংগঠনের দাবি, এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার পশতুন নিখোঁজ রয়েছেন।আর ভয়েস অব বালোচ ফর মিসিং পার্সনস নামের আরেকটি সংগঠনের দাবি, বালোচিস্তানের নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তির সংখ্যা ছয় হাজার পাঁচশ। পিটিএম-এর প্রধান মনজুর আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তির পরিবারের সদস্যরা কার কাছে, কীভাবে অভিযোগ করতে হবে তা লোকজন জানেন না। তাছাড়া গোয়েন্দা দপ্তরের লোকেরা আমাকেসহ এবং পিটিএম-এর সদস্যদের এসকল তথ্য সংগ্রহ করতেও বাধা দিচ্ছে।”এদিকে ২০১৯ সালে বালোচিস্তান সরকার এবং ভয়েস অব বালোচ ফর মিসিং পার্সন নামের সংগঠনটি একটি চুক্তি সই করে। চুক্তি অনুযায়ী, বেসরকারি সংস্থাগুলো নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। এরপর থেকে সংগঠনটি সরকারকে নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে।সংগঠনটির চেয়ারম্যান নসরুল্লাহ বালোচ বলেন, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বালোচ ছাত্রছাত্রীদের উপর সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে। কয়েক মাস আগে করাচি বিশ্ববিদ্যারয়ের এক বালোচ নারী আত্মঘাতী হামলে করলে সারাদেশে বালোচ জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। ‘‘এরপর থেকে দেশজুড়ে প্রায় তিনশ বালোচ শিক্ষার্থীকে গুম করা হয়েছে,” দাবি তার।‘আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’রহিম বলেন, ফিরোজ খুব সাধাসিধে একজন শিক্ষার্থী ছিল। সে সবসময় পড়াশোনা নিয়ে থাকতো এবং শিক্ষকেরাও তাকে খুব পছন্দ করতেন। বালোচিস্তানের শিক্ষা বিস্তারে তার বড় স্বপ্ন ছিল।মানবাধিকার কর্মী ইমরান বালোচ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত কয়েক মাস বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা বালোচ জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাঝে বিশেষ করে নিরীহ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে।”এদিকে ফিরোজের নিখোঁজ হওয়ার মামলাটি নিয়ে টালবাহানা করছে কমিশন অব ইনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্স এমন দাবি, মামলার আইনজীবী ইমান মাজারির। এই পরিস্থিতিতে মামলাটিকে বর্তমানে ইসলামাবাদের একটি আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।‘আইনের তোয়াক্বা করছে না গোয়েন্দারা!’পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়্যারম্যান ও দেশটির সাবেক সিনেটর আফরাসিয়াব খাত্তাক জানান, তিনি সিনেটর থাকা অবস্থায় গুম হয়ে যাওয়ার এসকল ঘটনার তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির তদন্তে দেখা গেছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা দপ্তর এসকল গুমের ঘটনার সাথে জড়িত। তিনি বলেন, ‘‘গোয়ন্দেদের আইনের আওতায় আনতে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি আইন প্রণয়ন করার কথা বলেছিলাম। বারবার বলার পরও তারা আমার অনুরোধে সাড়া দেয়নি। ‘তার অভিযোগ, ‘গোয়েন্দা দপ্তরের সদস্যরা কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলতে চায় না।’
আরও পড়ুন
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২
তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে যুদ্ধ
হারিকেন হেলেনে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৯০ জনের মৃত্যু