জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
গ্রাম বাংলার চিরচেনা রূপ বোঝাতে এখনও পাঠ্যবই কিংবা নাটক-সিনেমায় দেখানো হয় কুঁড়েঘর বা ছনের তৈরি ঘর। ঐতিহ্যবাহী এসব ঘর দেখতেও যেমন নান্দনিক; তেমনি প্রচণ্ড শীত কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহে বেশ আরামদায়কও। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনমানে আসছে পরিবর্তন। আর এর প্রভাবে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে নানান গ্রামীণ ঐতিহ্য; ট্নি আর পাকা ঘরের স্থায়িত্বের কাছে টিকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে এই কুঁড়েঘরও।
কয়েক দশক আগেও মৌলভীবাজারের কুলাউড়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় ছনের ঘর দেখা যেতো। সেইসময় পাহাড় থেকে ছন কেটে শুকিয়ে তা বিক্রির জন্য ভার বেঁধে হাটে নিয়ে যাওয়া হতো। এই হাটগুলো এক সময় এলাকাভিত্তিক ‘ছনখোলা’ নামেও পরিচিত ছিল। চা বাগানের মালিকপক্ষ শ্রমিক দিয়ে ছন কেটে শুকিয়ে বাগানে ছনের ঘর তৈরি করে দিতেন। পুরো গ্রামে চলতো ছনের ঘর বানানোর আমেজ। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌলভীবাজারের চা বাগানের ভেতর ঐতিহ্যের নিদর্শন ছিল ছনের ঘর। গ্রামীণ এলাকার গরিব-মধ্যবিত্তের বাড়ির ঘরের ছাউনির একমাত্র অবলম্বন ছিল এই ছন। সেই সময় ছন মাটি কিংবা বেড়ার ঘরে ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর এখন মানুষ পাকা-আধাপাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করছে টিনকে। পাহাড়েও এখন আগের মতো ছন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গ্রাম থেকে ছনের ব্যবহার ক্রমশ বিলুপ্তির পথে।
কুলাউড়া উপজেলার জয়নুল নামের এক দিনমজুর বলেন, ‘আগের মতো পাহাড় নেই, আর যাও আছে সেখানে আগের মতো ছন পাওয়া যায় না। যেসব জায়গায় ছন হতো সেখানে আর হয় না কিংবা পাহাড় উজাড় করে সেখানে অন্য চাষাবাদ হচ্ছে। আগে প্রতিবছর ঘরে পুরনো ছনের ছাউনি সরিয়ে নতুন করে ছন লাগানো হতো। অবশ্য এখনও কেউ কেউ অর্থাভাবে, আবার কেউ আরামের জন্য টিনের পরিবর্তে ছনকে ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করেন।
ব্যবসায়ী রিতন পান্ডে জানান, আগে তাদের দোকানও ছিল ছনের তৈরি। সেখানেই ব্যবসা কার্যক্রম চলতো। সময়ের সাথে পরিবর্তন করে এখন পাকা দোকান দিতে হয়েছে।
গ্রামে ছনের ছাউনির ঘর তৈরির জন্য আগে বেশ কিছু সংখ্যক কারিগর ছিলেন, যাদের বলা হতো ঘরামি। তাদের দৈনিক মজুরি ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। প্রথমে পুরাতন ছন তুলে নেওয়া হতো। প্রায় প্রতিবছরই ঘরের পুরাতন বাঁশ তুলে নতুন নতুন বাঁশ লাগানো হতো। তারপর নতুন ছন উপরে তোলা হতো। এরপর আগার পাতলা অংশ কেটে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপে ছাউনি বাঁধা হতো।
উপজেলার সবকটি বাজারে ছনের ছাউনি দিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে তার নিচে বাজার বসতো। কালের বিবর্তনে মৌলভীবাজারের সবকটি উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে এখন ছন খুব কমই দেখা যায়। সাধারণ গ্রামের মানুষ ঘর তৈরিতে ছাউনি হিসেবে আগের মতো ছনের ব্যবহার করেন না।
কুলাউড়া উপজেলার সনজিৎ বলেন, এখন আর মাঠে-ঘাটে, হাট-বাজারে ছন দেখা যায় না, গ্রাম এলাকাতেও ছনের ঘর এখন সহজে চোখে পড়ে না। ছন আর ছনের ঘর আরও কিছুদিন গেলে হয়তো একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ছনের ঘরে বসবাস করা খুবই আরামদায়ক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছনের ঘর গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা ও শীতকালে গরম থাকে। ছনের ঘর তৈরি করার ঘরামি বা মিস্ত্রীর খুব কদর ছিল। গ্রামে খুব একটা দেখা না গেলেও শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন পার্কের দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য বৈঠকখানায়, রেস্তোরাঁ, পাকা বাড়ির সামনে কিংবা বাগানে বসে আড্ডা দেওয়ার ঘর কিংবা কোনও শুটিং স্পটে এখন ছনের ঘরের দেখা মেলে। আবার গায়ে হলুদ, বিয়েসহ বিভিন্ন ইভেন্টেও দেখা যায় ছনের ব্যবহার। অনেকেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পাকা বসতঘরের উপর তলায় ছনের তৈরি ছোট ঘর বানান।
স্থানীয় কামরান আহমদ বলেন,‘সময়ের পরিবর্তনে এখন শহরে বিনোদন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ও শুটিং স্পট ইত্যাদি জায়গায় ছনের ঘর তৈরি করা হচ্ছে। শহরের মানুষ ছনের বেড়া আর ছনের তৈরি নান্দনিক ঘরে আনন্দের সঙ্গে কিছু সময় পার করছেন। বাস্তবতা মেনে হয়তো এই ঘর খুব একটা দেখা পাওয়া যাবে না। তবে এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাইলে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি