নিজস্ব প্রতিবেদক:
রেমিট্যান্স প্রবাহে বেড়ে গেছে হুন্ডি তৎপরতা। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলের রেমিট্যান্সে বড় পতন হচ্ছে। হুন্ডি চক্রে বৈধপথের রেমিট্যান্স বন্দি হয়ে পড়ার কারণে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মূলত ব্যাংকের চেয়ে ভালো রেট পাওয়া এবং খরচ কম হওয়ায় প্রবাসীদের একটি অংশ রেমিট্যান্সে পাঠাতে অবৈধ পন্থা জেনেও হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে অন্তত ৬ টাকা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে বেড়ে যাচ্ছে হুন্ডি প্রবণতা। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলে বর্তমানে বিমান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় প্রবাসীরা অন্যজনের কাছেও নগদ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে। তাতে রেমিট্যান্সে প্রণোদনার পরও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে কমছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২৭১ কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ। পরিস্থিতির উন্নয়নে জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সে প্রণোদনার হার সরকার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। বর্তমানে প্রবাসে থাকা এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে গ্রাহকরা প্রতি ডলারের বিনিময়ে পায় ৮৪ টাকা ৫০ পয়সার মতো। আর প্রতি ডলার পাঠাতে খরচ হয় গড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ টাকা। সরকারের প্রণোদনার ২ শতাংশ যোগ করে এবং খরচ বাদ দিয়ে ১০০ ডলারে আসলে পাওয়া যাচ্ছে ৮ হাজার ২০০ টাকা। অথচ কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৯০ টাকা ৬০ পয়সার মতো দর পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে কেউ ক্যাশ ডলার আনলে বা কারো কাছে পাঠালে সুবিধাভোগী পায় ৯ হাজার ৬০ টাকা। আর হুন্ডি চক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে দেশ বি ত হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনীতির জন্য তা ক্ষতি বয়ে আনছে।
সূত্র জানায়, করোনায় বিশ্বব্যাপী লকডাউনের মধ্যে প্রথমবারের মতো এযাবৎকালের মধ্যে রেমিট্যান্স ২ হাজার কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। অথচ ওই সময় বিশ্বের অনেক দেশে আয় কমেছিল। প্রবাসীদের একটি অংশ কাজ হারিয়ে কিংবা করোনা পরিস্থিতিতে ছুটি নিয়ে দেশে চলে আসে। পাশাপাশি নতুন করে বিদেশে যাওয়াও বন্ধ ছিল।
সূত্র আরো জানায়, সাধারণত বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে তা হুন্ডি চক্র মেটায়। ব্যাংকিং চ্যানেলে কেউ পাঠালেও প্রবাসীর সুবিধাভোগী দেশে টাকা পায়। আর হুন্ডি এজেন্ট বিদেশে প্রবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা কিনে দেশে টাকা পরিশোধ করে। ব্যবসার পাশাপাশি যারা বিদেশে বাড়ি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তারাও নানাভাবে হুন্ডি চক্রের দ্বারস্থ হয়।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে এক হাজার ২৪ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছে। অথচ করোনার মধ্যে গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল এক হাজার ২৯৪ কোটি ডলার। ওই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২৭১ কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ। একই সময়ে আমদানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ২৩০ কোটি ডলার বিক্রির পরও ডলারপ্রতি এক ডলার বেড়ে আন্তঃব্যাংকেই ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায় উঠে। আর রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। তার আগে ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ব্যাপক কমে গিয়েছিল। তখন হুন্ডি প্রবণতা কমানোর উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি লেখে সরকার। পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমার কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৭ সালের শুরুর দিকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দুটি টিম পাঠায়। ওই প্রতিনিধি দল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে রেমিট্যান্স কমার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বাইরে বেশি অর্থ পাওয়া। তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো ও অর্থ পাচার ঠেকাতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে সরকার রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ না কমিয়ে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২০ সালে করোনায় বন্ধের মধ্যে প্রবাসীদের আয় কমে গেলেও রেমিট্যান্স ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। ওই বৃদ্ধি ছিল ক্ষণস্থায়ী। মূলত হুন্ডি চাহিদা কম থাকায় তখন প্রবাসী আয়ের প্রায় পুরোটা বৈধ চ্যানেলে এসেছিল। তাছাড়া ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্যও বিদেশে যাওয়া বন্ধ ছিল। ফলে ডলারের চাহিদা ছিল কম। এখন সব খুলে যাওয়ায় চাহিদা বেড়েছে। তাতে হুন্ডিও বেশি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো প্রয়োজন। হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। তাছাড়া প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজ নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারে না। মূলত হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়া ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমার একটি অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম জানান, করোনার কারণে হুন্ডি বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হয়তো হুন্ডি। তবে শুধু একক কারণে রেমিট্যান্স কমছে না।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ