নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সব সময় ঠেকিয়ে দেয় সুন্দরবন। এ কারণে বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বন বলা হয় বাংলাদেশের ঢাল। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন দেশের অমূল্য সম্পদ। জীবন-জীবিকার অন্যতম আধার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন থেকে গাছ কাটা, বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়া হুমকিস্বরূপ। বাঘ থাকলে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকে, কমে গাছ কাটা। কিন্তু চোরা শিকারিদের দাপটে সেই বাঘও হুমকির মুখে। ক্রমেই কমছে বাঘের সংখ্যা। নষ্ট হচ্ছে বাস্তুসংস্থান। এছাড়া গত কয়েক বছরে আগুনে সুন্দরবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হরিণ শিকার চলছেই। পানিতে বিষ দিয়ে মাছ ধরা পরিণত হয়েছে একটি বড় সমস্যায়। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পাশাপাশি জলজ প্রাণী ও পাখ-পাখালি হুমকির মুখে। জানা গেছে, সুন্দরবনে ৬০ শতাংশ এলাকা অভয়াশ্রম। সেখানে চুরি করে নদীতে মাছ ধরার কাজ চলে। বৈধ যে জায়গাটুকু রয়েছে সেখানে সাধারণ জেলেরা মাছ ধরতে পারে না। মাছ ধরার বৈধ জায়গাগুলো প্রভাবশালীদের দখলে। বৈধ জায়গায় প্রভাবশালীদের কারণে মাছ না ধরতে পেরে জেলেরা অভয়াশ্রমে গিয়ে মাছ ধরে। এ ছাড়া সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়। আর বিষ দিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টি বন বিভাগের পদক্ষেপও খুব নগণ্য। সামগ্রিকভাবে সুন্দরবনকে সংরক্ষণ করার জায়গায় অনেক পিছিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনে স্বচ্ছ পানি ও লবণাক্ত পানি মিশ্রিত হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে স্বচ্ছ পানি কমে যাওয়ার কারণে লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। গত ২০ থেকে ৩০ বছরে সুন্দরবনের অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ছে। বনের নদী-খালে মিঠা পানির প্রবাহ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এদিকে পলিমাটি জমে বনের বেশকিছু খাল ভরাট হয়ে গেছে। এতে করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, সুন্দরবনে অতিমাত্রায় লবণাক্ততায় সুন্দরী গাছ মরে যাচ্ছে, বন্যপ্রাণীরাও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব নানা কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনের হুমকির কথা জানিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের বলেন, সুন্দরবনে উজান থেকে পানি আসছে। নদীতে একাধিক বাঁধ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ, পানির যে প্রাকৃতিক ¯্রােত তা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। লবণ পানির পরিমাণ বাড়ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। বনের ভেতরে ও আশপাশে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সরকারি-ব্যক্তিগত উদ্যোগে একাধিক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এসব স্থাপনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক লোক জনসমাগম ঘটে। এ ছাড়া বাঘ কমে যাওয়া সুন্দরবনের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। খুলনা বন অধিদপ্তরের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, সুন্দরবন রক্ষা চলমান প্রক্রিয়া। বন যতদিন থাকবে ততদিন সুন্দরবন রক্ষায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের প্রধান একটি এজেন্ডা ছিল সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত করা। সেটি এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সুন্দরবনে আগে বিভিন্ন কাঠ বিশেষ করে সুন্দরী, কেওড়া ও পশুর পাচার হতো, সেটি এখন বন। এ ছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনের যে চ্যালেঞ্জ সেটি এখনো রয়ে গেছে। সুন্দরবন এলাকায় জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লোনা পানি বাড়ায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। যার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। হরিণ শিকার আগের তুলনায় কিছুটা কম হলেও আমরা একেবারে বলতে পারি না বন্ধ হয়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে বন সংরক্ষণে কাজ করে চলেছি। আইলা, আম্ফান ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি করে। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারিভাবে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বন বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাকৃতিকভাবে যে ক্ষতি হয় তা একটি সময় পর ধীরে ধীরে প্রাকৃতিকভাবেই আগের অবস্থানে চলে আসে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে হরিণ মারা গেলে হরিণ তৈরি করার সাধ্য নেই। তবে যেগুলো থাকবে সেগুলো রক্ষা করলে পরবর্তীসময়ে বাড়বে বলে আশা করা যায়। ঘূর্ণিঝড়ে অবকাঠামোগত যেসব ক্ষতি হয়েছিল সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুন্দরবন সংরক্ষণ ও এর প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর এমন আগুনে কয়েক একর জায়গা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এদিক থেকে মানুষকে সচেতন করতে হবে। মানুষ সচেতন না হলে, না বুঝলে সুন্দরবন রক্ষা করা কঠিন। সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। মিঠা পানির উৎস কমে গেছে। বনের বেশকিছু খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে আছে এবং বিভিন্ন এলাকায় চড় জেগেছে। বনে লবণ পানির আধিক্য বেশি। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরীসহ বিভিন্ন গাছ নানা রোগে মারা যাচ্ছে। লবণ পানি খেয়ে বন্যপ্রাণী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকির মুখে। তিনি বলেন, তারা সুন্দরবন সংরক্ষণ ও বনসংলগ্ন মানুষের জীবন জীবিকার মানউন্নয়নের জন্য সুন্দরবন পরিচালনার ক্ষেত্রে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি পূরণ হলে বন এবং বনসংলগ্ন মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে বলে তিনি আশাবাদী। এছাড়া সুন্দরবনের ভেতর প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুন্দরবনের ভেতর পর্যটকরা যেখানে সেখানে প্লাস্টিক ফেলে রেখে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর শ্বাসমূল ভেসে ওঠে, আর প্লাস্টিকের কারণে যদি শ্বাসমূল আটকে যায় তাহলে নিশ্চিত মারা যাবে গাছগুলো। নিয়ম করে হলেও যদি সুন্দরবনের ভেতর প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা যায় তাহলে দূষণ কমে আসবে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম