নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, দেশে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৪ কোটি ৭৮ লাখ টন খাদ্যশস্যের (দানাদার খাদ্যশস্য) উৎপাদন হয়েছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১৩ লাখ টন বেশি। ওই বছর দেশে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৮২ হাজার টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল। তবে দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে অনুপাতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। কোনো কোনো ফসলের ক্ষেত্রে এ হার নেতিবাচক।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষকের আয় না হওয়াসহ নানা কারণ কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বৈশ্বিকভাবে কৃষিপণ্যের দাম বাড়লে দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধাক্কা আসতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা মহামারীকালে তা বেশ টের পাওয়া গেছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে এখনো বেশ ভোগাচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি।
এদিকে গত নভেম্বরে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘গ্লোবাল ইনফরমেশন অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম অন ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার শীর্ষক’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ ধানসহ দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। পাশাপাশি দাম বেশি থাকায় মানুষের কেনার সামর্থ্য কমে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এফএও মনে করছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ৭ লাখ ৯৩ হাজার টন বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন হতে পারে। এর মধ্যে বোরো ধান উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হতে পারে, ৩ কোটি ১০ লাখ টন। ফলে এবার সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্য কম আমদানি করতে হবে।
তবে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যপণ্য কেনার সক্ষমতা কমছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ার পরও কেন খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তার কিছু কারণ এফওএর প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণে উৎপাদন খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র ও বিপদাপন্ন পরিবারগুলোর খাবার কেনার সক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বরে খাদ্যপণ্য খাতের মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে প্রায় ১ দশমিক ৮০ শতাংশ পয়েন্ট কমে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে নামে। এর আগের মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে বিবিএসের হিসাবে গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এদিকে এফএও’র প্রতিবেদনে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশ। এছাড়া গমে ৩ শতাংশ, ভুট্টায় ৮, আলুতে ১, ডালশস্যে ৬, বেগুনে ৫, কুমড়ায় ৭, মটরশুঁটিতে ৯, তেলশস্যে ৭, কলায় শূন্য দশমিক শূন্য ২, পেয়ারায় ২ ও কাঁঠালে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এছাড়া লালশাকে ১ শতাংশ, আমে শূন্য দশমিক ২ ও আনারসে ২ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
আবার ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশ। এছাড়া গমে ২, ভুট্টায় ৬, আলুতে ২, ডালশস্যে ৫, বেগুনে ৫, কুমড়ায় ৭, মটরশুঁটিতে ৬, তেলশস্যে ৬, পেয়ারায় ১, লালশাকে ৩ ও কাঁঠালে ১ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর কলা উৎপাদনে শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ, আমে শূন্য দশমিক ৩৪ ও আনারসে ২ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। অর্থাৎ চাল, বেগুন, কুমড়া ও আনারসের ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার একই।
শুধু আলু ও লালশাকের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। তবে গম, ভুট্টা, ডালশস্য, মটরশুঁটি, তেলশস্য, কলা, পেয়ারা, আম ও কাঁঠাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। তিন অর্থবছরে কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছিল গড়ে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও কোনো অর্থবছরেই সে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ দশমিক ২ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।
অন্যদিকে, এফএও’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশ বোরো, ৩৫ শতাংশ আমন ও ১০ শতাংশ আউশ থেকে আসে। চলতি বছর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। চট্টগ্রামে ভারি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে আমনের ক্ষতি হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদন ভালো হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে। তবে আউশে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উৎপাদন হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার ৫ কোটি ৮৫ লাখ টন ধান উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভালো আবহাওয়া থাকায় ভুট্টার উৎপাদন ভালো হয়েছে।
এবার মোট ৪৭ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হবে বলে সংস্থাটি মনে করছে। মাছ ও মুরগির খাবার উৎপাদনকারী কারখানা বা ফিড মিলগুলোতে ভুট্টার চাহিদা বেশি ছিল। দামও ছিল ভালো। ফলে কৃষকও বেশি উৎপাদন করেছে। উন্নত মানের ও উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার জাত এনে চাষাবাদ করার কারণেও উৎপাদন বেড়েছে বলে এফএও মনে করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ এসব খাবার কিনে খেতে পারছে না। এতে এসব দরিদ্র মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি এসব পণ্যের আমদানি ও সরবরাহ নিশ্চিত করাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওেয়ার পরামর্শ তাদের। আর দরিদ্র মানুষের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া না হলে তারা কবলে পড়বে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম