নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে অহরহ বাড়ছে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা। গত দুই বছরে ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে চিকিৎসা ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছেন ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ১৪ শতাংশই। নিয়মিত চিকিৎসা না করায় ইনসুলিন নেওয়ার পরও ৮০ ভাগের বেশি রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর থেকেই ডায়াবেটিস সহ সব ধরণের ওষুধের দাম বেড়ে চলেছে। ডায়াবেটিস পরীক্ষায় ব্যবহৃত স্ট্রিপ, ইনসুলিন এবং মুখে খাওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
ক্রমবর্ধমান এই চিকিৎসা ব্যয় ডায়াবেটিস রোগীকে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকিতে ফেলছে। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির মতে, বাংলাদেশে আনুমানিক এক কোটি ৩১ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন; ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর থেকেই ডায়াবেটিস সহ সব ধরণের ওষুধের দাম বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫৪ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০৪৫ সালে ৭৮ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। ২০২১ সালে বিশ্বে ৬৭ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লাখ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দেশের ৬৫ শতাংশই জানে না তাদের ডায়াবেটিস আছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ১০০ জনের মধ্যে ২৬ জন নারীই গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। যাদের ৬০ শতাংশই পরবর্তীকালে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
এসব রোগীর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ৩২০ জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, সর্বশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে যে গবেষণা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, দেশে মোট জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছে। ডায়াবেটিস থেকে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। এর মধ্যে প্রধান হলো হৃদরোগ। হৃদরোগের ৮০ শতাংশই রোগী ডায়াবেটিসের কারণে মারা যায়। ৪০-৪৫ শতাংশের কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয় ডায়াবেটিসের কারণে।
এ ছাড়া অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস রোগীর ২৯ শতাংশ রেটিনোপ্যাথিতে ভুগছেন। ডায়াবেটিসের কারণে প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের প্রকল্প পরিচালক ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক বলেন, ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালেই ডায়াবেটিস রোগী বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে ছিল ৮৪ লাখ। সেখানে দুই বছরের মাথায় তা গিয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩০ লাখে। যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর চিত্র। আরও ভয়ের বিষয় হচ্ছে অনেকেই জানেন না তাদের ডায়াবেটিস আছে। উপসর্গ না থাকায় ৬০ ভাগ লোকই জটিলতা হওয়ার পরে চিকিৎসা নেন।
বারডেম একাডেমির পরিচালক ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক পাঠান বলেন, ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। এ রোগ কখনো সম্পূর্ণ সারে না। সারাবিশ্বেই এই রোগটি আছে। এই উপ-মহাদেশে প্রকোপ কিছুটা বেশি। ডায়াবেটিসের কিছু ঝুঁকি আছে পরিবর্তন করা যায় এবং কিছু যায় না। কারও পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং বংশে কারও ডায়াবেটিস থাকলে সেক্ষেত্রে অন্যরা কায়িক পরিশ্রম না করলে, ওজন ও মেদ বাড়লে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকেন। এ ছাড়া হার্টের রোগী, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, কোলেস্টরেল বেশি, ধূমপান করেন, শরীরে ইনুসলিনের কার্যক্ষমতা কম, তারা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
ঝুঁকি কমাতে পারলে রোগটি প্রতিরোধ সম্ভব। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নগরায়ন ও জীবনযাপনের ধরনের পরিবর্তনের কারণে দিন দিন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডায়াবেটিস একবার হলেই চিকিৎসা নিতে হয় আজীবন। অতিরিক্ত ফাস্টফুড ও চর্বিযুক্ত খাবার খেলে, শারীরিক পরিশ্রম না করলে, নিয়মিত শরীরচর্চা না করলে, স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যাদের ডায়াবেটিস নেই, তারা যদি ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে জানতে পারেন এবং সেসব ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে পারেন তাহলে অনেকটাই প্রতিরোধ সম্ভব।
এছাড়াও সঠিক খাদ্যাভাস এবং জীবনমানের পরিবর্তন করে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও ঝুঁকি এড়ানো যায়। ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ কে আজাদ খান আরও বলেন, বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না এমন কোনো ডায়াবেটিস রোগ নেই। দেশে বেশিরভাগ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী নিয়ন্ত্রণ করেন না বা করতে জানেন না। বাংলাদেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মহামারি চলছে। শুরুতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ থাকে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে এটি।
এজন্য ৪০ বছরের বেশি সবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা জরুরি। যাদের ঝুঁকি বেশি তারা ৩০ বছর হলেই পরীক্ষা করবে। চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ডায়াবেটিসপ্রবণ দেশ এবং বাস্তব পরিস্থিতি এর চেয়েও গুরুতর। বর্তমানে শহর ও গ্রামে প্রায় সমানভাবে বেড়ে চলেছে ডায়াবেটিসের রোগী। তাই গুরুতর অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এখনই এটি প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। তারা আরও বলেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সর্বস্তরের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা এবং ডায়াবেটিক রোগীর সেবায় সুলভে ওষুধ সরবরাহ থেকে শুরু করে অন্যান্য সহযোগী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি