November 23, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, January 17th, 2024, 9:56 pm

সংকটের মধ্যেই বাড়বে গ্যাসের দাম

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজধানীর বাসিন্দারা ভোরে উঠার সাথে সাথে প্রতিদিনের লড়াইয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন, উদ্বিগ্নভাবে ভাবেন যে চলমান তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে খাবার রান্না করতে তাদের গ্যাসের চুলা জ্বলবে কিনা। এটি একটি নিত্যদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসের চাপ সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে না বললেই চলে, আর দুপুর বেলাতে চুলা নিভে যাচ্ছে। এমন দুর্ভোগের মধ্যে সরকার গ্যাসের দাম আরও এক ধাপ বৃদ্ধির কথা ভাবছে। যা ইতোমধ্যে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত নাগরিকদের উপর অর্থনৈতিক চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। সূত্র জানিয়েছে, আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

গ্যাসের দাম কতটা বাড়বে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে খাতভেদে বাড়ানোর হার ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ হতে পারে। জ¦ালানি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বর্তমানে দুটি চুলায় মাসিক বিল ১০৮০ টাকা, তবে বর্তমান বিলের সাথে ৫১২ টাকা যোগ করার প্রস্তাব রয়েছে। বাস্তবায়িত হলে মাসিক বিল হবে ১৫৯২ টাকা। একটি চুলার বিল এখন ৯৯৯ টাকা এবং বর্তমান বিলের সাথে ৩৯০ টাকা যোগ করার প্রস্তাব রয়েছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ইতোমধ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করেছে। কমিটি ইতোমধ্যে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থাকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাঠাতে চিঠি দিয়েছে। বাণিজ্যিক খাতেও বাড়ানো হবে গ্যাসের দাম। শিল্পমালিকেরা প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি। এখন কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম ১৬ টাকা। এটা ২৫ টাকা করা হলে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ।

বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম এখন ১১ টাকা ৯৮ পয়সা। এটি বাড়িয়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি করা হতে পারে। জ¦ালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ দফায় দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমদানি বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিদেশ থেকে বাড়তি দাম দিয়ে কিনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো হবে। এজন্য বেশি টাকা লাগবে। ভর্তুকি কমাতে সেই টাকার একটা অংশ ওঠানো হবে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে। ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম দিতে রাজি। যদিও এর আগে দুই দফা সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল।

কিন্তু পরে গ্যাস আমদানি বাড়ানো হয়নি। এবার আবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এমন একটা সময়ে, যখন শিল্প খাত গ্যাস-সংকটে ভুগছে। অনেক এলাকার বাসাবাড়িতেও দিনের বেশির ভাগ সময় চুলা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরপুর, কুড়িল, বসুন্ধরা, বাড্ডা, মহাখালী ও ধানমন্ডির বাসিন্দারা অনেকে দিনের বেলায় খাবার রান্না করতে পারেন না। আর অনেকেই এখন রাতে গ্যাসের চাপ পেলে রান্না করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন যে তারা তাদের চাহিদা মেটাতে বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার করছেন বা অতিরিক্ত ১৫০০ টাকা খরচ করে গ্যাস সিলিন্ডার কিনেছেন।

মিরপুরের গৃহকর্মী শিরীন অক্তার সাথে কথা বল্লে তিনি বলেন, চুলায় সকাল থেকে গ্যাস নেই। খাবার রান্না করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রান্না করতে আমি বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার করি। আজিমপুরে বসবাসকারী হ্যাপি আক্তার বলেন, সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত গ্যাস পাই না। এখন আমি অফিসের পরে গভীর রাতে রান্না করি। জীবন আমাদের জন্য সত্যিই কঠিন। অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে শ্যামলী এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আরাফাত রহমানের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।

রহমান বলেন, গ্যাসের অভাবে বাড়িতে ঠিকমতো রান্না করা যায় না। আমাকে প্রায়ই বাইরের হোটেল থেকে খাবার কিনতে হয়। এটি শুধুমাত্র পরিবারের খরচ বাড়ায় না, হোটেলের খাবারের খরচও বাড়িয়ে দেয়। মুদ্রাস্ফীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে এভাবে খরচ পরিচালনা করা আমাদের পরিবারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে মাসিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতভাবে, বর্তমান সরবরাহ দেশব্যাপী ২.৫ বিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২০ সালের এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন।

সূত্র জানায়, দুটি রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করা হয় এবং পরে তা গ্যাসে রূপান্তরিত হয় এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে একটি টার্মিনাল গত ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। দুটি টার্মিনালের একসঙ্গে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতা ছিল। একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় বর্তমান সরবরাহ কমে গেছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

এদিকে মঙ্গলবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল হামিদ বলেন, আমরা গত কয়েকদিন ধরে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়া লক্ষ্য করছি। শীতের মৌসুমে গ্যাসের চাপ কম হওয়ার কারণে এমনটি হতে পারে। আমরা আশা করি খুব শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।” তিনি আরও বলেন, আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “অন্য অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে গ্যাস অন্যতম। ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নিয়ে আমাদের সমস্যা রয়েছে। আমরা আশা করি দুই দিনের মধ্যে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। মার্চ থেকে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য আমাদের একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে। রমজান মাস ঘনিয়ে আসছে। আমরা রমজানকে বিবেচনা করে এই পরিকল্পনা নিয়েছি,” তিনি বলেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমাদের দুটি এফএসআরইউ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৬ এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এইগুলি যোগ করা হবে। আমাদের অনুমান যে ২০২৭ সালের মধ্যে গ্যাসের চাহিদা ৬০০০ মিলিয়ন ঘনফুট-এ দাঁড়াবে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। তবে আমরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। আমাদের ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে আমরা প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন করছি। তাৎক্ষণিক এই গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন জনেন্দ্র নাথ সরকার। তবে বর্তমানে ডলার মজুতের যে অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনাও কম।

বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের দাম পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে ১৭৪ শতাংশের বেশি। পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নজর না দিয়ে সরকার আমদানিতে গেছে। এর মাশুল এখন দিতে হচ্ছে। গ্যাস খাতের অনিয়ম ও অপচয় কমিয়ে এবং সরকারি ভর্তুকি সমন্বয় করে দাম না বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, শিল্পসহ সব গ্রাহক গ্যাসের খরায় ভুগছে। এর মধ্যে নতুন করে দাম বাড়ানোর কোনো নৈতিক অবস্থান নেই সরকারের। এটা গ্রাহকের কাছ থেকে লুণ্ঠনের শামিল, চরমতম প্রতারণা।