নিজস্ব প্রতিবেদক:
এবার পাটের দামে বেজায় খুশি কৃষক। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে পাট। এমনকি এক বছরের বেশি সময় ধরে সরকারি ২৫টি পাটকল বন্ধ থাকলেও পাটের দামে কোন প্রভাব পড়েনি। বরং করোনা মহামারীর মধ্যে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় পাটের বেশ ভাল দাম পাচ্ছেন কৃষক। চড়া দামেই এ বছর পাটের কেনাবেচাও শুরু হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমণ পাট দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৩৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা দামেও প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত দামে পাট বিক্রি হয়নি। তবে কাঁচা পাটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি পাটকল মালিকরা খুশি নয়। তাদের মতে, এত বেশি দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাতে দেশে পাট পণ্যের উৎপাদন কমে যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষক এবং পাট খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে পাটকল বন্ধ হলেও বিশ্বব্যাপী এই প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা বাড়ছে। যে কারণে রফতানিও বাড়ছে। পাশাপাশি পাট দিয়ে এখন বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে। ফলে দেশেও আগের চেয়ে অনেক বেশি পাটপণ্য উৎপাদন হচ্ছে। সব মিলিয়ে পাট নিয়ে এখন আর কৃষকের দুশ্চিন্তা নেই। বরং পাট বিক্রি করে কৃষক এত মুনাফা পাবে তা কোন দিন চিন্তাই করা যায়নি। এক সময়ে দেশে যেখানে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়ার জন্য কৃষকের পক্ষ থেকে দাবি উঠতো, সেখানে এখন শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়ার দাবি উঠছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে পাটের বাজারের অবস্থা। বাজারে পাট বিক্রি করে এবার কৃষকরা বেজায় খুশি। কারণ গতবারের চেয়ে মণে প্রায় হাজার টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে পাট।
সূত্র জানায়, দেশে পাট নিয়ে কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। কোথাও খাল-বিল, পুকুর কিংবা ডোবায় পাট কেটে জাগ দেয়ার জন্য ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। আবার হাইওয়ে কিংবা গ্রামীণ রাস্তার পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে সারি সারি করে পাট শুকাতে দেয়া হয়েছে। কোথাওবা আবাদকৃত পাটগাছ কেটে জাগ দিয়ে সেখান থেকে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ততা চলছে। আবার কেউ কেউ আঁশ ছাড়ানো পাট শুকিয়ে ঘরে তুলছে। গ্রামাঞ্চলের অনেক জায়গায় সড়কের দু’পাশে নারী ও পুরুষকে পাট শুকানোর কাজ করতেও দেখা যাচ্ছে। আবার অনেকে অটোরিক্সা, ভ্যান, ভটভটি দিয়ে পাট নিয়ে বাজারে যাচ্ছে। নদীতে যেমন সারি সারি পাটের নৌকা, তেমনি সড়কেও সারি সারি পাটের অটোরিক্সা, ভ্যান, ভটভটি। ফলে নতুন পাটের গন্ধে এখন গ্রাম-গঞ্জ মাতোয়ারা। যদিও এ বছর পাটের বীজ বপন ও পরবর্তী কিছুদিন খরা দেখা দেয়ায় পাটের জমিতে কৃষকদের ১-৩টি অতিরিক্ত সেচ দিতে হয়েছে। তবে পরবর্তীতে বৃষ্টিপাত ভাল হওয়ায় পাটের ভাল ফলন হয়েছে এবং কর্তনকৃত পাট সহজেই কৃষকরা জাগ দিতে পারছে। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের কোন কোন স্থানে পানি না থাকায় পাটগাছ জাগ দিতে কৃষকদের কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়েছে। তবে পরবর্তীতে বৃষ্টি হওয়ায় ওই সমস্যা কেটে যায়। ঠিকমতো পাট কেটে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে শুকিয়ে ওই পাট এখন বাজারে বিক্রির ধুম পড়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত কয়েক বছর ধরেই পাটের দাম ভাল যাচ্ছে। তার মধ্যে গত বছর (২০২০ সাল) পাটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পাটকাটা মৌসুমের শুরুতেই প্রতিমণ পাট ২ হাজার থেকে ২২শ’ টাকা দরে বিক্রি হয়। পরে তা ৩৫শ’ টাকা এবং মৌসুমের শেষ পর্যায়ে হাটে প্রতিমণ পাটের দাম ৫ হাজার টাকা পৌঁছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী গত বছর প্রতিমণ পাটের গড় মূল্য হয়েছিল ৩৫শ’ টাকা। পাট চাষ করে ৩ মাসের মধ্যে পাট ঘরে তোলা যায়। কম সময় এবং কম পরিশ্রমের ফসল পাট। প্রতি বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ মণ পাট উৎপাদন হয়। তবে এ বছর কোন কোন অঞ্চলে প্রতি বিঘায় ১৫ মণ পর্যন্ত পাট উৎপাদন হয়েছে। এবার বাজারে পাটের মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে দু’একটি জেলায় প্রতিমণ পাট সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। এত দামে বিক্রির কারণে পাট চাষের খরচ বাদ দিয়েও এবার পাট চাষীরা অভাবনীয় মুনাফা পাচ্ছে। আর দেশের সব জেলায়ই কম-বেশি পাটের চাষ হয়। তবে ফরিদপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয়। ওই জেলার মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষে বিশেষ উপযোগী। যে কারণে ফরিদপুরের পাট ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
এদিকে গত বছর থেকে পাটের দাম সন্তোষজনক হওয়ায় কৃষকরা পাট চাষে আবারো আগ্রহী হয়ে উঠছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৮২ লাখ টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে দেশে এবার ৮ থেকে সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। আশা করা যায় তা থেকে কমবেশি ৯০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হবে। দেশে উৎপাদিত পাটের আঁশের পায় ৫১ শতাংশ পাটকলগুলোয় ব্যবহৃত হয়, ৪৪ শতাংশের মতো কাঁচা পাট বিদেশে রফতানি হয় এবং মাত্র ৫ শতাংশের মতো ঘর-গৃহস্থালি আর কুটির শিল্পের কাজে লাগে। যদিও বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে পাট হতো। তবে মাঝে তা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা বাড়ায় ২০১০-১৫ সাল নাগাদ চাষের এলাকা বেড়ে ৭ লাখ হেক্টরে পৌঁছায়। তারপর থেকে তা আরো বাড়ছে। তবে আগে ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখন ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি পাট পাওয়া যাচ্ছে। বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাত লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়। সেখান থেকে ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার টন পাট উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল সেখান থেকে ৮০ লাখ টন পাট পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৬ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। সেখান থেকে ৮০ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মোঃ আইয়ুব খান জানান, দেশে পাটকল বন্ধ হলেও বিশ্বব্যাপী এই প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা বাড়ছে। যে কারণে রফতানি বাড়ছে। পাশাপাশি দেশেও পাটপণ্য উৎপাদন হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। আর দীর্ঘসময় ধরেই পাটের এত দাম ছিল না। গত দুই বছর থেকে পাটের দাম খুব ভাল যাচ্ছে। তাতে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে পাট আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে উৎপাদনও। সারাদেশে এ বছর পাটের উৎপাদন ৮০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বেশ বেড়েছে। যদিও গত বছর ঘূর্ণিঝড় আমফানে পাটের বেশ ক্ষতি হয়। এ বছর প্রথমে খরার কারণে সমস্যা হলেও পরে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় পাটের উৎপাদন বেড়েছে। তাছাড়া পাটের সঙ্গে প্রতি বছরই নতুন নতুন চাষী যুক্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি