অনলাইন ডেস্ক :
কথা রাখলেন লিওনেল মেসি! প্রিয় বন্ধুর শেষ ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। ম্যাচের আগে স্থানীয় গণমাধ্যমকে মেসি বলেছিলেন, ‘ডি মারিয়ার সাহচর্য আমি দারুণ উপভোগ করেছি। জয়ের আনন্দ নিয়ে ও যাতে মাঠ ছাড়তে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়েই ফাইনালে খেলতে নামবো।’ যেই কথা সেই কাজ। গোড়ালির চোটে মেসি পুরো সময়টা হয়তো মাঠে থাকতে পারেনি, তবে প্রিয় বন্ধুর বিদায়টা খালি হাতে হয়নি। কোপার শিরোপা তুলে দিতে পারার আনন্দে চোখ ছলছল করে উঠছিল মেসির! প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল নিতে পেছনে ছুটছেন মেসি। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে আচমকাই মাটিতে পড়ে যান এই মহাতারকা। মাঠেই কিছুক্ষণ চিকিৎসা নিলেও আর খেলা চালিয়ে যেতে পারেননি আর্জেন্টিনা অধিনায়ক।
৬৬ মিনিটে মাঠ ছেড়েছেন কান্নাভেজা চোখে। ডাগআউটে বসে অঝোরে কেঁদেছিলেন। সেই কান্না যেন থামছিলই না। অতিরিক্ত সময়ে লাউতারো মার্টিনেজের গোলেই চোখে-মুখে আলোর ঝলকানি ফুটে ওঠে মেসির। ডাগআউটে বসে বন্ধুর জন্যই হয়তো মন খারাপ করেছিলেন। বদলি খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে নেমে লাউতারোই যেন ডি মারিয়াকে দেওয়া মেসির দেওয়া কথা রাখার সুযোগ করে দিলেন! বিশ্বকাপ জিতেই আকাশি-নীল জার্সির প্রতিনিধি হয়ে সবুজ গালিচা ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন ডি মারিয়া। কিন্তু মাঠ কাঁপানো প্লেমেকারকে ছাড়তে চায়নি আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন (এএফএ)।
সবার চাওয়ায় ৩৬ বছর বয়সী তারকা থেকে গেলেন আরও কিছু দিন। নক্ষত্রের পতন তো হয়ই, তবে আর্জেন্টিনার উইঙ্গারের ক্ষেত্রে নক্ষত্রের পতন বলা ঠিক হবে না। ডি মারিয়ার ক্ষেত্রে নক্ষত্রের বিদায় বলটাই যুক্তিযুক্ত হবে। আর্জেন্টিনার ফাইনাল মানেই যেন ডি মারিয়ার গোল! ২০০৮ অলিম্পিকে আলবিসেলেস্তেদের জয়সূচক গোল এসেছিল তার কাছ থেকেই। ২০২১ কোপা আমেরিকার ফাইনালের মতো ২০২২ ফাইনালিসিমাতেও গোলের দেখা পেয়েছিলেন তিনি।
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষা ফুরানোর মিশনেও তার অবদান। এসব কীর্তি গড়েই দ্য বয় অব ফাইনালস হয়ে উঠেছেন আর্জেন্টিনার ছোট্ট শহর রোজারিওর এক নিম্নবিত্ত পরিবার জন্ম নেওয়া ডি মারিয়া। সোমবারের ফাইনালে গোল করতে না পারলেও মেসির অনুপস্থিতিতে যেভাবে মাঠ সামলেছেন, সেটিও কম কী! ম্যাচের ১১৭তম মিনিটে মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হয় ডি মারিয়াকে। পুরো সময়টাতে কলম্বিয়ার ডিফেন্স ভেঙে দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন আর্জেন্টিনার এই তারকা। ফাইনালে গোল পেলে হয়তো ডি মারিয়ার শেষটা দারুণ হতো। তাতে অবশ্য আর্জেন্টিনার এই তারকার কিছুই যায় আসে না। ১৬ বছরের ক্যারিয়ার নিয়ে নিজেই তো ভীষণ খুশি আর্জেন্টিনা ভক্তদের কাছে নয়নের মণি হয়ে ওঠা ডি মারিয়া; খুশি তার ভক্তরাও।
নিজেই বলেছেন, ‘যা চেয়েছি, জীবন আমাকে সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি কিছু দিয়েছে।’ আর্জেন্টিনার ছোট্ট শহর রোজারিওর এক নিম্নবিত্ত পরিবার জন্ম হওয়ার ডি মারিয়ার ফুটবলার হওয়ার পথ এতটা সহজ ছিল না। অভাবের কারণে একটা সময় কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ছোট বয়সে তিনি ছিলেন বেশ দুরন্ত স্বভাবের। এই কারণে ডি মারিয়ার মা ছিলেন বেশ চিন্তিত। সন্তানকে ঠিক করতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেই চিকিৎসক পরামর্শ দেন তাকে কোন একটি খেলায় দিয়ে দিতে।
চিকিৎসকের কথামতো ডি মারিয়াকে ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তার মা। সেই শুরু, এরপর আর থামতে হয়নি আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরাকে। মাত্র চার বছর বয়সে ডি মারিয়া খেলা শুরু করেন রোজারিওর সেন্ট্রাল ক্লাবে। ছেলেকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে তার মা তাকে ক্লাবে নিয়ে যেতেন। কনকনে ঠান্ডার মধ্যে আধঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যেতেন মা ডায়ানা। টানা সাত বছর এভাবে ডি মারিয়াকে প্রতিদিন এভাবেই নিয়ে যেতে হয়েছে। ওই সময়টাতে ক্লাবে ফুটবল খেললেও শ্রমিক হিসেবে কাজ চালিয়ে যান তিনি। ১০ থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত, বাবা-মা এবং দুই বোনের সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে তাকে। এভাবেই আস্তে আস্তে খেলতে খেলতেই ডি মারিয়া হয়ে উঠেন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়। ২০০৭ সালে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান তিনি।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। রোজারিও নামের ওই ছোট্ট শহর থেকে পৌঁছে যান ইউরোপের ক্লাবগুলোতে। ৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ডি মারিয়াকে কিনে নেয় বেনিফকা। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৯। ওই ক্লাবে যোগ দেওয়ার পরই ভাগ্য বদলাতে শুরু করে ডি মারিয়ার পরিবারের। এরপর বাবা-মা-বোনকে আর কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে দেননি তিনি। আর্জেন্টিনার জার্সিতে অনূর্ধ্ব-২০ খেলেই ডি মারিয়া সুযোগ পেয়ে যান জাতীয় দলে। ২০০৮ সালে শুরু করে গুনে গুনে পেরিয়ে গেছেন ১৬ বছর। আন্তর্জাতিক ফুটবলের লম্বা এই সময়ে আর্জেন্টিনা বেশ কিছু শিরোপা জিতেছে, তাতে অবদান ছিল তার। দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে আর্জেন্টিনার বাঁ উইংয়ের ভরসার নাম হয়ে গেছেন ডি মারিয়া। আর শেষটাও করলেন এমনভাবে, যা শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়।
ম্যাচ শেষে ডি মারিয়া বললেন, ‘সত্যি হলো, এটাই লেখা ছিল, এভাবেই হতো। আমি এটা স্বপ্নে দেখেছিলাম। স্বপ্নে দেখেছিলাম যে ফাইনালে খেলবো এবং জিতে অবসর নিবো। আমার অনেক সুন্দর সুন্দর অনুভূতি আছে। এই প্রজন্মের কাছে আমি চিরঋণী। আজ আমি শিরোপা নিয়ে বিদায় নিচ্ছি।’ ট্রফি হাতে নেওয়ার সময় ডি মারিয়া ও নিকোলাস ওতামেন্দিকে সঙ্গে নেন মেসি। অধিনায়ককে নিয়ে এই প্লেমেকার বলেন, ‘তাকে মাঠ ছাড়তেই হতো। গোড়ালিতে চোট পেয়েছিল সে। শেষ পর্যন্ত তার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি।’
আরও পড়ুন
তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে যুদ্ধ
হারিকেন হেলেনে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৯০ জনের মৃত্যু
নেপালে ভয়াবহ বন্যা, ভূমিধসে মৃত্যু বেড়ে ১৯২