জেলা প্রতিনিধি, সিলেট:
ভারতের কলকাতায় পাঁচতলা পাঁচটি বিলাসবহুল বাড়ি, যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৪৫ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ১০ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা বাড়ি। যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১২ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জ স্টেডিয়ামের পাশে রয়েছে আড়াই বিঘা জমি। যার বাজারমূল্য আনুমানিক সাড়ে ১৭ কোটি টাকা।
এসব সম্পত্তির মালিক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার কান্তি সাহার। এই কর্মকর্তা এতোটাই প্রভাবশালী যে, তিনি সরকার কিংবা রাষ্ট্রের কোনো আইন কিংবা নির্দেশনার ধারও ধারেন না। যখন তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যান সরকারের অনুমতি ছাড়াই।
সম্পত্তি কিনে ওই দেশের পাসপোর্টধারীও হয়ে গেছেন তিনি। ওই পাসপোর্টেই চলে অবাধ যাতায়াত। এক ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পের পিডি হওয়ার সুযোগ নেই। অথচ তিনি একাই হাফ ডজন প্রকল্পের পিডি সেজে বসে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, ভারতের বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে তার নগদ অর্থ ও এফডিআর। দেশে তার ভাই বোনদের নামে করেছেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, কিনেছেন আরো অনেক সম্পদ।
জাতীয় সংসদের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপিত প্রতিবেদন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে দেয়া অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে মন্ত্রণালয়ও তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত করে একাধিক অভিযোগের বিষয়ে সংসদীয় কমিটিকে অবহিত করেছে।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সরকারের বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগ, পাসপোর্টের তথ্য গোপন, ভারতে অর্থ পাচার করে পরিবার পরিজনদের বাসস্থান তৈরি, চাকরিকালীন দুর্নীতি, দুর্নীতির দায়ে দুদক কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়া, সরকার দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠাতে চাইলেও বিভিন্ন অজুহাতে যেতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, সওজ সিলেট জোন আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রহস্যজনকভাবে অনুপস্থিত থাকা।’
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অন্য একটি দেশের নাগরিক হয়েও বাংলাদেশ সরকারের একটি দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিভাবে তিনি কাজ করছেন তা নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল সংসদীয় কমিটি। সেই তদন্তে তুষার কান্তি সাহাকে দোষী করা হয়নি, আবার ছাড়ও দেয়া হয়নি।
দায়সারাভাবে তদন্ত হওয়ায় প্রতিবেদনটি আমলে নেয়নি সংসদীয় কমিটি। এজন্য সচিবকে দিয়ে নতুন করে তদন্ত করাতে বলা হয়েছে। সচিব না পারলে অন্তত অতিরিক্ত সচিব মর্যাদার কাউকে দিয়ে তদন্ত করার কথা বলেছে সংসদীয় কমিটি। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সচিবকে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন বলেন, অভিযোগ উঠেছে। কিভাবে একজন সরকারি কর্মকর্তা অবৈধ পাসপোর্ট নিয়ে অন্য দেশে বসবাস করেন-এসব বিষয় তদন্ত করে বলা যাবে। আমরা সঠিক তথ্য জানতে আবারো তদন্তের কথা বলেছি।
তিনি বলেন, উনি বিভাগের সঙ্গে নিয়মমাফিক চলেন না। শুনেছি উনি ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। অভিযোগের সত্যতা জানতে আমরা তাকে তলবও করেছি।
বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, তুষার কান্তি সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর সংসদীয় কমিটি মন্ত্রণালয়ের কাছে তদন্ত রিপোর্ট চেয়েছে। কিন্তু রিপোর্টটি কমিটির কাছে সন্তোষজনক হয়নি। তাই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব কিংবা অতিরিক্ত সচিবের মাধ্যমে পুনরায় তদন্ত করিয়ে রিপোর্ট দিতে বলেছে কমিটি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার কান্তি সাহার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ইতোমধ্যে সওজ সিলেট জোনের এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জন, ভারতে অর্থ পাচার করে সেখানে জমি ক্রয় ও বাড়ি তৈরি করার অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগে বলা হয়, তুষার কান্তি সাহা ১৯৮৯ সালের ১৬ মে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় তৈরি শুরু করেন তুষার কান্তি। ঢাকায় সওজের স্ট্রাকচার ডিজাইন বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ১৯৮৯ সালের ২১ জুন থেকে ১৯৯২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত থাকা অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
এরপর রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার শর্তে একক ক্ষমতাবলে বিপুল অংকের টাকা নিয়েছেন। গোপালগঞ্জে চাকরিকালীন সময়ে এলটিএম, আরএফকিউ, ফেরি, ব্রিজ টোল অনিয়ম এবং বিভিন্ন নামে শত শত কোটেশন করে অবৈধভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন।
তুষার কান্তি সাহা ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক সার্কেল খুলনা, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৯৫ পর্যন্ত সড়ক সার্কেল বরিশাল এবং ঢাকায় ব্রিজ ডিজাইন বিভাগ-৩ এ ১৯৯৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ১৯৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর ১৯৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০১ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কুষ্টিয়া সড়ক উপ-বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
একই পদে ৩০ এপ্রিল ২০০১ থেকে ৭ এপ্রিল ২০০৭ পর্যন্ত মানিকগঞ্জ সড়ক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। এর মাঝে তিনি মির্জাপুর সড়ক বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে ৮ এপ্রিল ২০০৪ সাল থেকে প্রায় এক বছর বিনা অনুমতিতে ভারতে পলাতক থাকেন এবং এজন্য তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলেও অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে। পরে দীঘিনালা সড়ক উপ-বিভাগে ২০০৫ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৭ আগস্ট এবং একই বছরের ১৮ আগস্ট থেকে ২০০৮ সালের ২৭ মে পর্যন্ত তিনি নয়ারহাট সড়ক উপ-বিভাগে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
নড়াইল সড়ক বিভাগে ২০০৮ সালের ২৮ মে থেকে ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তুষার কান্তি। এছাড়া, ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগে এবং একই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত শরিয়তপুর সড়ক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ২০১২ সালের ৯ আগস্ট থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগে এবং একই বছরের ১২ এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ৮ মে পর্যন্ত ঢাকার প্ল্যানিং ডিভিশনে এবং ২০১৩ সালের ১৯ মে থেকে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা সড়ক বিভাগে তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এরপর ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্রিজ ডিজাইন সার্কেল ঢাকায় এবং ২০১৭ সালের ১২ মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ২৮ জুন পর্যন্ত রাজশাহী সড়ক সার্কেলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে ২০১৮ সালের জুন থেকে একই বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রাম জোনে, একই বছরের ৭ নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত গোপালগঞ্জ জোনে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তুষার কান্তি সাহা।
সর্বশেষ বর্তমানে তিনি সড়ক ও জনপথ সিলেট জোনে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বে আছেন। অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি এই জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তার অনিয়মের মাত্রা বেড়ে যায়। সরকারি নিয়ম অগ্রাহ্য করে ৬টি প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি।
প্রকল্পগুলো হচ্ছে- বানিয়াচং-আজমিরিগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন, বিমানবন্দর বাইপাস ইন্টারসেকশন-লালবাগ-সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়ক জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ, গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ (সিলেট জোন), সিলেট শহর বাইপাস গ্যারিসন রোড টু শাহপরান সেতু ঘাট সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, জৈন্তা থেকে জাফলং পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন এবং সিলেট এলাকায় জেলা মহাসড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ প্রকল্প।
এ নিয়ে এক বৈঠকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পরিকল্পনামন্ত্রীও। সেই মিটিংয়ে প্রকল্পের অবস্থা সম্পর্কে তুষার কান্তি সাহা বলতে শুরু করলে পরিকল্পনামন্ত্রী প্রশ্ন করেন, ‘আপনি একা ৬টি প্রকল্পের পিডি হলেন কিভাবে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘এভাবেই তো চলছে স্যার।’ তখন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানলে এটা করা যাবে না।’
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি