November 23, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, October 11th, 2021, 8:54 pm

ক্লিন ফিড ইস্যুতে সরকার অনড়

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে ক্লিন ফিড তথা বিজ্ঞাপনমুক্ত অনুষ্ঠান সম্প্রচার বাস্তবায়নে অভিযানে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ব্যাপারে আগেই জানিয়েছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, যেসব চ্যানেলে ক্লিন ফিড আসার পরও যারা (ক্যাবল অপারেটর) তা সম্প্রচার করছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে মোবাইল কোর্ট। ক্যাবল অপারেটররা নিয়মনীতি মানছে কি না- তাও খতিয়ে দেখবে মোবাইল কোর্ট।
বেশ আগে থেকেই বিজ্ঞাপনযুক্ত এসব চ্যানেলে দেশে সম্প্রচার বন্ধ করার কথা বলা হলেও সম্প্রতি এ বিষয়ে কঠোর হয় সরকার। গত ১৩ সেপ্টেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১ অক্টোবর থেকে বিদেশি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করা হয়। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চ্যানেল বন্ধ করতে গিয়ে ক্লিন ফিডের চ্যানেলগুলোও বন্ধ হয়ে যায়।
পরে গত ৫ অক্টোবর সব চ্যানেল বন্ধ না রেখে বিজ্ঞাপনবিহীন (ক্লিন ফিড) বিদেশি টিভি চ্যানেলে বা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের নির্দেশ দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের একটি চিঠি দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বরের পর ক্লিন ফিড ছাড়া কোনও বিদেশি টিভি চ্যানেল বা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে পারবে না মর্মে সংশ্লিষ্ট সকলকে পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছেÑ কোনও কোনও বিদেশি টিভি চ্যানেল ক্লিন ফিড থাকা সত্ত্বেও গত ১ অক্টোবর থেকে সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে। যা কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬-এর পরিপন্থী।
তবে বাংলাদেশে ক্লিন-ফিড দেয় এমন ২০টিরও বেশি বিদেশি চ্যানেল আবারো চালু হয়েছে। পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর চ্যানেলগুলো চালু হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আনোয়ার পারভেজ।
তিনি বলেন, ক্লিন-ফিড পাওয়ার কারণে ১৫টি চ্যানেলের সম্প্রচার আবারো চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো যেসব চ্যানেলের ক্লিন-ফিড পাওয়া যাবে সেগুলোর বিষয়েও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। পাওয়া গেলে সেগুলোও চালু করা হবে।
সম্প্রচার চালু করতে পারা চ্যানেলগুলো হলো– বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ, বিবিসি আর্থ, ডি-ডাব্লিউ, সিসিটিভি, ফ্রান্স ২৪, আল জাজিরা, ফিনিক্স ইনফো নিউজ, এবিসি অস্ট্রেলিয়া, সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল, লোটাস ম্যাকাও, এইচবিও এইচডি, সিএনবিসি গল্ফ, লাইভ স্পোর্ট, এএক্সএন এইচডি, ওয়ার্নার টিভি, এনএইচকে-ওয়ার্ল্ড জাপান, চ্যানেল নিউজ এশিয়া, এনিম্যাক্স এইচডি, সৌদি কুরান, সৌদি সুন্নাহ, কেবিএস কোরিয়া, রাশিয়া টুডে, আরিরাং, সিজিটিভি এবং ট্রাভেলএক্সপি।
ক্লিন ফিডের এই ব্যাপারটি নতুন নয়। বিজ্ঞাপনমুক্ত (ক্লিন ফিড) বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে দেড় দশক আগে ২০০৬ সালে ‘কেব্ল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন’ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আইনটির প্রয়োগের জন্য এর চার বছর পর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বিধিমালা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে আইনটির প্রয়োগে দুটি সরকারেরই তেমন তাড়াহুড়ো ছিল না। তবে ২০১৯ সালের মার্চ থেকে এ নিয়ে বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেলের পরিবেশক ও কেব্ল অপারেটরদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করা হয়। এরপর চলতি বছরের ১ অক্টোবর আইন প্রয়োগ শুরু করে সরকার।
দীর্ঘ সময় পেলেও পরিবেশক ও অপারেটর বিদেশি চ্যানেলকে ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপনমুক্ত করে প্রচার করার জন্য কোনো প্রস্তুতিই নেয়নি। আইনের ১৯(১৩) ধারা অনুযায়ী, ১ অক্টোবর যখন আইনের প্রয়োগ শুরু হয়, তখন তারা বিজ্ঞাপনমুক্ত চ্যানেলসহ বিদেশি সব চ্যানেলের সম্প্রচারই বন্ধ করে দেয়। তবে দেশের একমাত্র ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) আকাশের গ্রাহকেরা বিজ্ঞাপনমুক্ত কিছু চ্যানেল দেখতে পারছিলেন। সেই চ্যানেলগুলোর বেশির ভাগই সংবাদভিত্তিক।
এই খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত আইনটির প্রয়োগ হবে, কেব্ল অপারেটর ও পরিবেশকেরা ভাবেননি। তাঁদের ধারণা ছিল, সরকার আরও এক দফা সময় দেবে। এমন ধারণাও কারও কারও মধ্যে ছিল যে অপারেটররা চ্যানেল বন্ধ করে দিলে দর্শকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। সরকার আবার সময় দেবে। কিন্তু দর্শকদের মধ্যে চ্যানেল বন্ধে কিছু অসন্তুষ্টি থাকলেও সরকারের উদ্দেশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন তাঁরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্লিন ফিড চ্যানেল দেখানোর জন্য কেব্ল নেটওয়ার্ক সিস্টেম ডিজিটাল করা প্রথম শর্ত। এটা হলে পরিবেশক, অপারেটরদের ফাঁকি দেওয়ার উপায় থাকবে না। ফলে প্রকৃত গ্রাহকের বিপরীতে ব্রডকাস্টার ও সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আবার ক্লিন ফিড (বিজ্ঞাপনমুক্ত) চ্যানেলের চেয়ে ডার্টি ফিড (বিজ্ঞাপনযুক্ত) চ্যানেল কিনতে ব্যয় কম হয়। সব মিলিয়ে এ খাতে আর্থিক লাভক্ষতির বিষয় আছে।
কেব্ল টিভির বাজার ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। নতুন করে ডিজিটালাইজড বা ক্লিন ফিড চ্যানেজের জন্য নতুন বিনিয়োগ দরকার। সেট টপ বক্সের মাধ্যমে ডিজিটালাইজড করতে গেলে ব্যয় হবে। প্রথম দিকে সব গ্রাহক সেট টপ বক্স না-ও কিনতে পারেন। সে ক্ষেত্রে গ্রাহক কমে যেতে পারে। অপারেটররা বলছেন, প্রতিটি সংযোগের সঙ্গে সেট টপ বক্স স্থাপনের জন্য গ্রাহককে ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা ব্যয় করতে হবে। বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেলের পরিবেশকদের ভাষ্য, সরকার শেষ পর্যন্ত তার অবস্থানে থাকলে চ্যানেলের বিজ্ঞাপনমুক্ত সম্প্রচারে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগতে পারে।
কেব্ল টেলিভিশনের এত বড় ব্যবসা যাঁদের ওপর নির্ভরশীল, সেই দর্শকেরা এখন সবচেয়ে বিপাকে। বিদেশি প্রিয় চ্যানেলগুলো তাঁরা দেখতে পারছেন না। অথচ কেব্ল টেলিভিশন দেখতে গ্রাহকেরা প্রতি মাসে অর্থ পরিশোধ করছেন।
এ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চ্যানেল ক্লিন ফিড করা পরিবেশক বা কেব্ল অপারেটরদের কাজ নয়। প্রতিটি ব্রডকাস্টার (চ্যানেল কর্তৃপক্ষ) ক্লিন ফিড ও ডার্টি ফিড আলাদা করে করে। কিনতে খরচ কম হয় বলে বাংলাদেশে ডার্টি ফিড ডাউনলিংক করা হয়।
এ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চ্যানেল ক্লিন ফিড করা পরিবেশক বা কেব্ল অপারেটরদের কাজ নয়। প্রতিটি ব্রডকাস্টার (চ্যানেল কর্তৃপক্ষ) ক্লিন ফিড ও ডার্টি ফিড আলাদা করে করে। কিনতে খরচ কম হয় বলে বাংলাদেশে ডার্টি ফিড ডাউনলিংক করা হয়।
বাংলাদেশ কেব্ল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজের দাবি, ক্লিন ফিড আনা বা সম্প্রচারের ক্ষেত্রে অপারেটরদের কিছু করার নেই।
অবশ্য একটি সূত্র বলছে, শ্রীলঙ্কার বাজার বাংলাদেশের তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। অথচ ক্লিন ফিড চ্যানেল ও বিদেশি বিজ্ঞাপন বিষয়ে দেশটির সরকারের অবস্থানের কারণে এ খাতে আয় বাংলাদেশের ৫ গুণ বেশি। এমনকি বাংলাদেশের তুলনায় নেপালের বাজার অনেক ছোট হলেও সেখানে ক্লিন ফিড চালু। ভারতও ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পুরো ব্যবস্থা ডিজিটাল করেছে। সেখানে কোনো অ্যানালগ পদ্ধতি নেই। ফলে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, অপারেটর, পরিবেশক এবং সরকার নিজ নিজ ভাগের টাকা বুঝে পাচ্ছেন।
বাংলাদেশে এ খাত নিয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশে ৪ হাজারের বেশি কেব্ল অপারেটর আছেন। এঁদের মধ্যে ১ হাজার ২০০র মতো অপারেটর স্যাটেলাইটে আপলিংক হওয়া চ্যানেল সরাসরি ডাউনলিংক করেন। সেই ব্যবস্থা তাঁদের আছে। বাকিরা এসব অপারেটরের কাছ থেকে নেন। আবার বিদেশি সব চ্যানেলের ডিস্ট্রিবিউটর বাংলাদেশে নেই। অনেক চ্যানেল আছে, যেগুলো সরাসরি স্যাটেলাইটে ব্রডকাস্টারের দেওয়া আপলিংক থেকে অপারেটররা কেব্ল ডাউনলিংক করেন।
বাংলাদেশের বাজার অ্যানালগ হওয়ায় প্রকৃত কেব্ল গ্রাহকের সংখ্যা জানা যায় না। তবে এ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে প্রায় সবার বাড়িতেই কেব্ল সংযোগ আছে। এ ছাড়া নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বাড়িতে সংযোগ আছে। সব মিলিয়ে সারা দেশে দেড় কোটির বেশি সংযোগ রয়েছে। প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি দেন গ্রাহকেরা।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদের কণ্ঠে অবশ্য কঠোরতা স্পষ্ট। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অপারেটরদের ক্লিন ফিড চ্যানেলের সম্প্রচার করতে হবে। আর সময় বাড়ানো হবে না। দুই বছর ধরে তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তাঁরা আইনকে পাত্তা দিচ্ছিলেন না। তবে বিজ্ঞাপনমুক্ত চ্যানেল সম্প্রচার করতে হবে, এ খাত ডিজিটালও করতে হবে। সরকারের দিক থেকে করণীয় যা কিছু থাকবে, সেটা করা হবে।