নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনার ধাক্কায় রপ্তানি খাতে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হলেও প্রবাসী আয় মোটামুটি ঠিক ছিল। তবে গেল কয়েক মাস ধরেই প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে খানিকটা ভাঁটা পড়েছে। জানা যায়, করোনা মহামারির সময়েও বিভিন্ন দেশে চাকরি পেয়েছেন বাংলাদেশিরা। প্রতিমাসে গড়ে ৬০ হাজার চাকরির সংস্থান হয়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগ সুযোগ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। তবে গেল বছরে হঠাৎ করেই চাকরির সুযোগ হতাশাজনক পরিস্থিতিতে নেমে আসে। এমনকি গেল বছরের এপ্রিল-জুনে কোনো অভিবাসন হয়নি। এ ঘটনার প্রভাব পড়তে শুরু করে পরবর্তীতে। কয়েক মাস পর হঠাৎ করেই রেমিটেন্সের তেজি ঘোড়া দৌড় থামিয়ে দেয়। কমতে থাকে প্রবাহ।
এতে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করলেও ঠিক এই সময়ের মধ্যে দেশে বেড়ে গেছে শ্রমশক্তি রফতানি। যার প্রভাব পড়বে আগামীতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিটেন্সের সুদিন ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আগামীতে আগের মতোই দেশে প্রবাসী আয় প্রবাহ বেড়ে যাবে।
সূত্র জানায়, তবে বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের দাম চড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য বা উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। সে কারণে সেখানে বেড়ে গেছে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানির হার। চলতি বছরের অক্টোবরে মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি পাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আগের মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে এ হার ৫৫ শতাংশ বেশি।
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে রিসিভিং কান্ট্রিগুলোতে পুরোদমে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। করোনার পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। জনশক্তি রফতানির সর্বোচ্চ শ্রমবাজার সৌদি আরবে ভিসা ইস্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশগুলোর সাথে বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। এ সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মী নিয়োগের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জনশক্তি রফতানিতে গতি বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন পর সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিজিট ভিসার পাশাপাশি এমপ্লমেন্ট ভিসা ইস্যু শুরু হয়েছে। ফলে আগামী ২০২২ সালে জনশক্তি রফতানিতে রেকর্ড পরিমাণ সাফল্য অর্জিত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একাধিক জনশক্তি রফতানিকারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। রেমিট্যান্স আয়ের ওপর ভর করেই দেশের জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি নারী-পুরুষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশিরভাগ কর্মসংস্থান হচ্ছে জিসিসিভুক্ত সৌদি আরব, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডান এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরে। তবে বাংলাদেশি প্রবাসীদের শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরব। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গেল অক্টোবর মাস পর্যন্ত সৌদিতে চাকরি পেয়েছেন প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি। যা এই সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৭৮ শতাংশ। কুয়েত, লেবানন, মরিশাস, ইতালি এবং যুক্তরাজ্যেও অল্প সংখ্যক বাংলাদেশির নিয়োগ ঘটছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। সীমিত হলেও বাংলাদেশিদের জন্য সেখানেও খুলে গেছে শ্রমবাজার।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখার অন্যতম মাধ্যম হলো প্রবাসী আয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব অনেক। করোনাকালে দেশের অর্থনীতি যখন স্থবির ছিল, যখন গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত গুরুত্বপূর্ণ সব খাত, এ সঙ্কটের মধ্যেও প্রবাসী আয়ে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ। স্থবির অর্থনীতিতে শক্তি যুগিয়েছিল সচল রেমিট্যান্স প্রবাহ। তবে চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে হঠাৎ করেই ধীরগতি দেখা যায় প্রবাসী আয়ে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকেই রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমতে শুরু করে। সদ্যবিদায়ী অক্টোবর মাসেও রেমিট্যান্স আয়ে ধীরগতি অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক এ তথ্য উঠে এসেছে।
হালনাগাদ প্রতিবেদনে অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশে ১৬৫ কোটি ডলারেরও কম রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। এরপর থেকে আর এত কম রেমিট্যান্স আসেনি। রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় সাড়ে ৪ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২১ শতাংশ কম। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। করোনাকালে প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়াসহ বেশকিছু কারণে রেমিট্যান্স কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় ফের হুন্ডি প্রবণতা বেড়েছে। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় কমে গেছে।
করোনা পরিস্থিতির পর ইউরোপের দেশগুলোতেও নতুনভাবে বাংলাদেশি দক্ষ কর্মীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। সম্প্রতি রোমানিয়া সফল শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, দেশটিতে ৪০ হাজার কর্মী যাবে। সম্ভাবনাময় নতুন এই শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায় সরকার। এরইমধ্যে স্বল্প খরচে খুব সহজেই কাজের ভিসা নিয়ে দেশটিতে পাড়ি জমাতে শুরু করেছেন বাংলাদেশিরা। এতে ইউরোপের শ্রমবাজারে নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু জনশক্তি রফতানিকারক ইউরোপের শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ইতালিতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ শুরু হয়েছে। এতে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের মাঝে আশার আলো দেখা দিয়েছে। বিএমইটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, করোনা মহামারি কমে আসায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ইউরোপের রুমানিয়া, হাঙ্গেরী, ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিকান ও সার্বিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এদিকে, বিএমইটি থেকে বিদেশগামী কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র হাতে পেতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর গলদঘর্ম। বিদেশগামী কর্মীর ছাড়পত্র ও স্মার্টকার্ড পেতে বিএমইটির টেবিলে টেবিলে ধরণা দিয়ে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে এজেন্সির প্রতিনিধিরা। বিদেশগামীদের অনেকেই স্মার্টকার্ড এক সপ্তাহেও পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। বহির্গমন ছাড়পত্র ও স্মার্ট কার্ড পেতে চরম হয়রানি ও অহেতুক বিলম্ব হওয়ায় রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধিরা সোমবার বিএমইটিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা বিদেশগামী কর্মীদের হয়রানি বন্ধ, বিএমইটির অব্যবস্থাপনার নিরসন এবং দ্রুত স্মার্টকার্ড সরবরাহের দাবি জানায়। বকশিস না দিলে বহির্গমন ইস্যুর ফাইল নড়াচড়া করে না বলেও অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে। যারাই ডিজির দফতরে লাইন ধরতে পারে, তারাই স্বল্পসময়ে বহির্গমন ছাড়পত্র পাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে।
সূত্রটি বলছে, অভিবাসন আইন ২০১৩ এর শর্তভঙ্গ করে বিএমইটির ডিজির নির্দেশে গত ৩১ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৬টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রতি ফাইলে ৯৯ জন করে ভিজিট ভিসার সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়াই বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ