নিজস্ব প্রতিবেদক:
চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতার ব্যাপকতা মাত্রা ছাড়িয়েছে। জানা যায়, মেম্বার (সদস্য) প্রার্থীদের মধ্যে আধিপত্যকে বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে গত ৮ নভেম্বর মেহেরপুর ও গত ৪ নভেম্বর নরসিংদীর সহিংসতা মেম্বার প্রার্থীদের কেন্দ্র করেই।
সূত্র জানায়, চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মতো মেম্বার প্রার্থীরাও এবারের ভোটে জবরদস্তি বা প্রভাব বিস্তার করছেন। ২৫৪জন চেয়ারম্যানের সঙ্গে ৮৩৪জন মেম্বার ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যবারের তুলনায় যে কারণে মেম্বার প্রার্থীরা সহিংসতা জড়াচ্ছেন বেশি। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ইউপি ভোটের ফাঁকা মাঠে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন। ট্রাম্পকার্ড হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন মেম্বার প্রার্থীরা। বিভিন্ন বলয় থেকে তৃণমূলে মেম্বার প্রার্থীদের সমর্থনও দেওয়া হচ্ছে। কোথাও স্থানীয় সংসদ সদস্য আবার কোথাও উপজেলা চেয়ারম্যান আবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের নিজ নিজ বলয় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সহিংসতা বাড়ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। আরও জানা গেছে, এবারের ভোটে মাদকসেবী ও কালোটাকার প্রভাব অনেক বেশি।
এ পর্যন্ত দুইধাপে ১১৯৭টি ইউপির ভোট সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৭৫৬টি ইউপিতে জয়লাভ করেছে। এর মধ্যে ভোট ছাড়াই রয়েছেন ২৫৪জন। সরাসরি ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৫০২টি ইউপিতে। অন্যদিকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে ৪১৬টি ইউপিতে। যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। স্বতন্ত্রদের মধ্যে প্রায় শতাধিক ইউপিতে জয়ী আবার বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এছাড়াও জাতীয় পার্টি-জাপা ১৩টি, জাতীয় পার্টি-জেপি-৫টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ৪টি, অন্যান্য দলের ৩জন বিজয়ী হয়েছেন। বেশিরভাগ জায়গায় আওয়ামী লীগের মুখোমুখি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। ভোটে জয়ী হতে বিদ্রোহীদের প্রভাব বিস্তারের কারণে সহিংসতাও বেড়েছে।
ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব সহিংসতায় সারা দেশব্যাপী গ্রেফতারও হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। সূত্র জানায়, ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় বৃহস্পতিবার ১৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেশের ২৫টি জেলায় সহিংসতায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। হত্যা মামলা হয়েছে ৪৩টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় দুই হাজার ব্যক্তিকে।
নিহতের মধ্যে নরসিংদীতে দুই দফায় ৯ জন, বরিশালে ছয়জন, কক্সবাজারে পাঁচজন এবং মাগুরায় চারজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া গাইবান্ধা, মেহেরপুর, রাঙামাটি ও ঢাকার ধামরাইয়ে দুজন করে নিহত হয়েছেন। সিলেট, নড়াইল, রাজবাড়ী, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, রংপুর, পাবনা, কুমিল্লা, মাদারীপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, মৌলভীবাজার, যশোর, ভোলা ও নওগাঁয় একজন করে নিহত হয়েছেন। নওগাঁয় বৃহস্পতিবার মারা যাওয়া ব্যক্তি ১২ নভেম্বর সংঘর্ষে আহত হন।
নির্বাচনে সংঘটিত সহিংসতার ব্যাপারে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই নির্বাচনে আমরা শুধু চেয়ারম্যান পদে প্রতীক দিচ্ছি, কিন্তু মেম্বার পদে কোনো প্রতীক নেই। তাদের কোনো প্রতীক থাকে না। আপনারা যদি ঘটনাগুলো দেখেন, মেম্বারদের মধ্যেও গোলমাল। শুধু যে চেয়ারম্যান প্রতীক দিচ্ছি দেখেই মারামারি তা কিন্তু না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচনী সহিংসতা অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে, তবে এটা ঠিক, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা আগেও হয়েছে। এখনও হোক সেটা চাই না। একটা হানাহানি, ভোট দিতে গিয়ে মানুষের প্রাণ যাবে এটা কখনও গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার কণ্ঠে অবশ্য ভিন্ন সুর বাজছে। নির্বাচনে ‘সেরকম’ কোনো সহিংসতা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তাঁর মতে, যেসব এলাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, সেসব এলাকা আগে থেকেই সহিংসতাপ্রবণ।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি সিইসি গত দুই ধাপের ইউপি নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন। এ সময় নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ও নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার উপস্থিত থাকলেও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও কবিতা খানম উপস্থিত ছিলেন না।
কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘আমার অঞ্চলভিত্তিক কথা বলা ঠিক হবে না। কিন্তু যেসব এলাকায় এসব ঘটনা (সহিংসতা) ঘটেছে, সেগুলো আসলেই একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জায়গা। এসব জায়গায় এ রকম ঘটনা ঘটে।’
এদিকে, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সহিংসতায় জড়িয়ে কোনো সমর্থক যদি মারা যান তবে তাঁর পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন এক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। রীতিমতো ইনস্যুরেন্স কম্পানির মতো করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা ও সংসার খরচের দায়িত্ব নেবেন ওই প্রার্থী।
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বাসাইল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাইফুল ইসলাম যুবরাজ এই ঘোষণা দেন। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কর্মকা- শুরুর আগেই তিনি গত ২৫ ও ২৬ অক্টোবর নিজ বাড়িতে কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে এই ঘোষণা দেন। বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর এ বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে দেখা যায়, সাইফুল ইসলাম বলছেন, ‘আমার নির্বাচন করতে গিয়ে যদি কোনো কর্মী মারা যান, তাঁর পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হবে। আর যদি খুনাখুনি-বাইড়াবাইড়ি করে হাসপাতালে ভর্তি থাকেন, তাহলে আমি সম্পূর্ণ খরচ বহন করব, তাঁর সংসারের খরচও আমি চালাব।’
সিরাজদিখানের ১৪টি ইউনিয়নে আগামী ২৩ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই ২৯ নভেম্বর, প্রত্যাহারের শেষ সময় ৬ ডিসেম্বর এবং প্রতীক বরাদ্দ হবে ৭ ডিসেম্বর। এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এই নির্বাচন পারপাসে লোক মারা যেতে পারে। আমার কর্মী যাঁরা তাঁদের একটা লিস্ট (তালিকা) আছে। এই লিস্টটা করতাছি, এই লিস্টটা আমার কাছে আছে।’
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি