November 15, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, November 24th, 2021, 8:39 pm

সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা, চলছে ফিটনেসবিহীন বাসও

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না কোনভাবেই। জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর থেকেই গণপরিবহন ও সড়কে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। টানা তিন দিন পরিবহন ধর্মঘটের পর বাড়ানো হয় ভাড়া। সরকার ঘোষিত বাড়তি ভাড়ার চেয়ে পরিবহনে আরও বেশি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রী-শ্রমিকদের মধ্যে চলছে বাক-বিতন্ডা, হাতাহাতি। শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়েও চলছে আন্দোলন। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করছেন।
সূত্র জানায়, বাসে অর্ধেক ভাড়া বা হাফ পাস চালুর দাবিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ও সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। সোমবার বেলা পৌনে ১১টা থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে রোববার ও রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে বেশ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়ার দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে। শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগে তরঙ্গ প্লাস পরিবহনের দুইটি বাস ঢাকা কলেজ এলাকায় আটকে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে অর্ধেক ভাড়া দিতে চাওয়ায় বাসচালকের সহকারী বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে হেনস্তা করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়। বাগবিতন্ডার একপর্যায়ে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে রোববার সকালে কলেজের ছাত্রীরা রাজধানীর বকশীবাজার মোড় আটকে দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন।
এক পর্যায় আশপাশের অন্য কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেন। অবরোধ চলাকালে চানখাঁরপুল পর্যন্ত খন্ড খন্ড বিক্ষোভ মিছিলও করা হয়। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষক ও পুলিশের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা সড়ক থেকে সরে আসেন।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, হেনস্তার ওই ঘটনা ঘটে শনিবার সকালে। ওই ছাত্রী শনির আখড়া থেকে ঠিকানা নামের একটি বাসে করে কলেজ আসছিলেন। বাসে অর্ধেক ভাড়া দিতে চাইলে চালকের সহকারী দুর্ব্যবহার করে।
জানা যায়, ২০১৫ ও ২০১৯ সালের ১ জুলাই প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সময় নগরীর যানবাহনগুলো গ্যাস চালিত দাবি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করে। তখন বাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বা শ্রমিক ফেডারেশন অনেকটা জোর গলায় বলেছিল, তাদের অধিকাংশ বাস সিএনজিতে চলে। সিএনজির দাম বেড়েছে, ফলে ভাড়া বাড়াতে হবে।
জার্মানভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যমের বাংলা সংস্করণের প্রতিবেদনে বিআরটিএর বরাত দিয়ে দাবি করা হয়েছে, ঢাকায় ৯৫ শতাংশ বাসই এখন সিএনজিচালিত। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার ভেতরে মোট বাস ১২ হাজার ৫২৬টি। তার মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হজার ৯০০টি। ডিজেলে চলে ৬২৬টি।
ঢাকাসহ সারা দেশে এখন ডিজেল ও সিএনজিতে কত বাস চলছে, সে বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান বিআরটিএর কর্মকর্তাদের কাছে নেই।
তাদের ভাষ্য, কোন কোন কোম্পানির বাস গ্যাসে চলে সেই ডেটাবেজও নেই। ২০০৮-২০০৯ সালের দিকে যখন ডেটাবেজ তৈরির কাজ শুরু হয়, তখন বেশির ভাগ বাস সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছিল। পরে রূপান্তরিত গাড়ির সমস্যার কারণে অনেকে আবার তেলে ফিরে আসে। এরপরে আর গ্যাসের বাস নামেনি। গ্যাসের বাস পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশের বেশি আছে।
সড়কে বিশৃঙ্খলা, বাড়তি ভাড়া ও নজরদারির অভাবে মালিকরা ডাম্পিংয়ে থাকা লক্কড়-ঝক্কড় পুরোনো গাড়িও রাস্তায় নামিয়েছেন বলে সূত্র জানায়। একদিকে ভাড়া বৃদ্ধি অন্যদিকে পুরোনো গাড়িতে চলাচল, দুর্ভোগ বাড়ছে যাত্রীদের। গণপরিবহনের এসব কারণে যন্ত্রণার যেন শেষ নেই।
রাজধানীর সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখন এসব রঙচটা ফিটনেসবিহীন বাস। আসন সংখ্যা বাড়াতে পরিবর্তন করা হচ্ছে গাড়ির নকশা। ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ৬ নম্বর বাস, অনাবিল, ছালছাবিল, বিকল্প, শিখর, শিকড়, তুরাগ, গ্রেট তুরাগ, তরঙ্গ পরিবহন, বলাকা, গাজীপুর পরিবহন, প্রভাতী বনশ্রী, ভিক্টর, আশিয়ান পরিবহনের বেশকিছু লক্কড়ঝক্কড় বাস চোখে পড়ে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বাবুবাজার থেকে কেরানীগঞ্জ, নয়াবাবাজর-গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত রুটের বাসগুলোর বেশিরভাগই ফিটনেসবিহীন। কোনটির এক অংশ খুলে পড়েছে কোনোটা দুমড়ানো মোচড়ানো। রঙ চটে গেছে অনেক আগেই। নেই সাইড ইনডিকেটর কিংবা পিছনের লাইট। ভেতরে বসার আসনগুলোও নড়বড়ে ও ছেঁড়া। বডি ভেঙে বাঁকা হয়ে থাকা, সামনে পেছনে বাম্পার নেই। চলার অযোগ্য বাসগুলোকে রঙ করে আবার নামানো হয় রাস্তায়। যাত্রাবাড়ী এলাকায় ওয়ার্কশপগুলোতে দেখা যায়, ভাঙা ও মেয়াদ উত্তীর্ণ যানবাহনগুলো হাতুরি পিটিয়ে ঘসা মাজা করে ঠিক করা হচ্ছে। নকশা পরিবর্তন করে বাড়ানো হচ্ছে বাসের আসন। পুরাতন গাড়িতে দেয়া হচ্ছে চকচকে রঙ। গাড়িগুলোকে রঙের কারসাজিতে ২০ বছরের পুরোনো বাস পরিনত করা হয় নতুন রূপে।
বাস ভাঙাচোরা হলেও ভাড়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। তাঁদের ভাষ্য, সময়-সুযোগ বুঝে বাস কন্ডাক্টর আদায় করছে বাড়তি ভাড়া। বাসের যে অবস্থা তা দেখে ভয় লাগে। মনে হয় যেকোনো সময় ভেঙে যাবে। বাসের সিটগুলো খুবই সঙ্কীর্ণ। ভেতরে সিটের ভাঙা অংশে অনেকের জামা-কাপড় ছিঁড়ে যায়। নজরদারীর অভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামছে। গণপরিবহনগুলোতে ফিটনেস সার্টিফিকেট রয়েছে, কিন্তু আসলে ফিটনেস নেই। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন।
এ বিষয়ে পুলিশের অভিমত অবশ্য একটু ভিন্ন। তাঁরা বলছেন, আমরা নিয়মিত ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। ফিটনেসবিহীন কিছু গাড়ির কারণে রাস্তায় অন্য গাড়িরও চলাচল করতে সমস্যা হয়। কোনো গাড়ির ফিটনেস না থাকলে ওই গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা-জরিমানা আদায় করছি। এমনকি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়। আর সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেয়ার সুযোগ নেই। অনেক যাত্রী আমাদের কাছে ভাড়া বেশি নেয়ার ব্যাপারে অভিযোগ করেন। অভিযোগ পেয়ে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। নির্ধারিত তালিকার বাইরে কেউ বেশি ভাড়া নিতে পারবে না।
চলমান সড়ক বিশৃঙ্খলা নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মধ্যেও। তাঁদের ভাষ্য, বাস চালক ও মালিকদের একচেটিয়া দৌরাত্ম্যের করণে এই নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। ভাড়া বাড়ানোর টাকা এবং চাঁদা আদায়ের টাকা কোন কোন খাতে যায় এটা পরিস্কার করতে হবে। বিআরটিএও দ্বায় এড়াতে পারেনা। আর বাস ভাড়া বাড়ানোর তালিকা চালকের সিটের নিচে রাখা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে দেখায়। কিন্তু এই তালিকার নির্ধারিত ভাড়াও মানা হয় না। পুরোনো ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। এটা বন্ধ করতে হবে। তা নাহলে এই বিশৃঙ্খলা থামানো যাবে না।