November 17, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, January 1st, 2022, 8:34 pm

অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বিকশিত হতে পারছে না পর্যটনশিল্প

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

অর্থনীতির মুকুট হচ্ছে পর্যটন। পর্যটনশিল্প ১০৯টি শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করে। পর্যটনশিল্প প্রতি আড়াই সেকেন্ডে একটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে ১১ জন মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান আরও ৩৩ জন। অর্থাৎ এক লাখ পর্যটকের আগমনে ১১ লাখ কর্মসংস্থান যুক্ত হয়। জাতিসংঘের টুরিজম বিষয়ক সংস্থা ইউএনডব্লিউ, ওয়াল্ড ট্রাভেল এ- টুরিজম কাউন্সিল, আইএটা বাংলাদেশ টুরিজম সেক্টরে বেশি বিস্তৃত ও সম্ভাবনাময় বলে উল্লেখ করেছে। এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে পর্যটনখাতে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০টি। পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে ২৩ লাখ ৪৬ হাজার। যা মোট কর্মসংস্থানের ৪ দশমিক এক শতাংশ। পর্যটনশিল্পে নিরন্তর নতুন যাত্রা যোগ হচ্ছে। কেননা পর্যটন খাত হচ্ছে ধোঁয়াবিহীন শিল্প।
কোভিড-১৯ মহামারি সারা বিশ্বে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছে। বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন খাত। এ খাতের সঙ্গে যুক্ত লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান, উদ্যোগ ও ব্যক্তি রীতিমতো পথে বসেছে। তবে ধীরে ধীরে করোনা মহামারির সংকট কাটিয়ে উঠছে বিশ্ব। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) মতে, বৈশ্বিক পর্যটন পুনরায় চালুকরণের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি এবং ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করেছে দেশগুলো।
চট্টগ্রাম বিভাগ পর্যটনের বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। কক্সবাজার ও তিন পার্তব্য জেলায় বাঙালি জাঁতি সত্তার সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অপূর্ব মেলবন্ধন রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও।
বর্তমানে অস্ত্র ও তেল শিল্পের পর তৃতীয় অর্থ আনয়নকারী শিল্প হলো পর্যটন শিল্প। পৃথিবীর বহু দেশের প্রধান আয়ই এই পর্যটন থেকে। যেমন মালদ্বীপ, মাদাগাস্কার, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং সমস্ত ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। পর্যটনের প্রধান অনুষঙ্গ পাহাড়, সাগর সমৃদ্ধ সবুজ প্রকৃতি। এই তিনটিই চট্টগ্রামে অবস্থিত। ফলে চট্টগ্রাম অনেক আগেই বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। অথচ পরিকল্পনা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার জন্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্প বিশ্বমানের অনেক নিম্নে। আবার সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির সীমাবদ্ধতায় এ দুই এলাকায় পরিবেশগত ক্ষতিও হয়েছে মারাত্মক আকারে। শুধু তা-ই নয়, গোটা দেশেই বনাঞ্চল, জলাভূমি, পার্বত্যাঞ্চল ও সাগরসৈকতকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলো দূষণ ও প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এর জন্য মূলত অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন কর্মকা-কেই দায়ী করা হচ্ছে বেশি।
দক্ষিণাঞ্চলীয় একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে সেখানকার বাস্তুসংস্থানে এরইমধ্যে ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কভিডের কারণে মাঝে কিছু সময় বিরতির পর আবারো দ্বীপটিতে প্রতিদিনই অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হয়েছে। হোটেল-রিসোর্টগুলোর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীন আচরণের পাশাপাশি পর্যটকদের অসচেতনতার কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্যরে দূষণ এসব এলাকায় এখন প্রকট হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, অপরিণামদর্শী ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো তৈরি এবং অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের ফলে সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজার-টেকনাফ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সুন্দরবনসহ দেশের প্রধান পর্যটন অঞ্চলগুলোর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে মোট ১৩টি স্থানকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে ঢাকার চারপাশে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু ছাড়া বাকি সব স্থানই পর্যটন এলাকা। দিন দিন এসব পর্যটন এলাকা প্রতিবেশগতভাবে আরো বিপন্ন হয়ে পড়ছে, যা এসব এলাকায় টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে সেন্ট মার্টিনের মতো নাজুক বাস্তুসংস্থানসংবলিত দ্বীপকে বাঁচাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দ্বীপটিতে যেকোনো ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করেই গড়ে উঠছে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছিল। প্রায় আট বর্গকিলোমিটার এলাকায় দ্বীপটিতে স্থায়ী প্রায় নয় হাজার বাসিন্দার বিপরীতে দৈনিক ভিড় করছে গড়ে আট হাজারের বেশি পর্যটক। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষের চাপ ঠেকাতে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৪টি বিধিনিষেধ জারি করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। যদিও প্রতিনিয়তই সেগুলো লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সিলেট, কুয়াকাটার বিভিন্ন স্পট দেশী পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এসব এলাকায় হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন অনেকেই। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো তৈরির কারণে এসব পর্যটন এলাকার পরিবেশ এখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।
বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে প্রতি বছর দেশী-বিদেশী পর্যটকরা সেখানে যান। বর্তমানে কভিডের কারণে বিদেশী পর্যটক তেমন না থাকলেও কমেনি দেশী ভ্রমণকারীর সংখ্যা। যদিও অতিরিক্ত দর্শনার্থীর ভারে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে বনের ইকো সিস্টেমের ওপর। সুন্দরবনে সুন্দরীসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি ও ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য রয়েছে। এ কারণে দর্শনার্থীদের কথা বিবেচনায় রেখে বন বিভাগ সাতটি জায়গায় গড়ে তুলেছে ইকো ট্যুরিজম। তবে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত দর্শনার্থী যাওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে গোটা বাস্তুসংস্থানের।
জানা গেছে, বর্তমানে সুন্দরবনে ছোট-বড় প্রায় ৭০টি পর্যটকবাহী নৌযান পর্যটকদের নিয়ে বিভিন্ন ভ্রমণ প্যাকেজ পরিচালনা করছে। আগে প্রতিটি নৌযানে ৫০-৭০ জন করে পর্যটক পরিবহন করলেও বর্তমানে কভিডের কারণে কোনোটিতেই ৫০ জনের বেশি যাত্রী নিতে দেয়া হচ্ছে না। সে হিসেবে প্রতিদিন তিন হাজারের মতো পর্যটক সুন্দরবনের বিভিন্ন স্পটে যাচ্ছেন।
যদিও প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে জড়িতরা বলছেন, বনের কোন অংশে প্রতিদিন কতজন দর্শনার্থী যেতে পারবে, সে বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার উল্লেখ থাকা উচিত। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতেই নতুন নতুন পর্যটকবাহী নৌযান পরিচালনার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। যেখানে প্রতিদিন ২৫০ জন দর্শনার্থীর ধারণক্ষমতা রয়েছে, সেখানে দেখা যায় হাজারের বেশি যাচ্ছে। সচেতনতার অভাবে অনেকেই নদীতে প্লাস্টিকের বোতলসহ বিভিন্ন বর্জ্য ফেলছে। জাহাজভর্তি পর্যটক নিয়ে উচ্চশব্দ করে গান বাজিয়ে পিকনিক আয়োজনের ঘটনাও ঘটছে, যা বনের পরিবেশ নষ্ট করছে।
প্রচলিত গন্তব্যের পাশাপাশি গত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকাগুলো তরুণ পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রেমাক্রি, তাজিংডং, চিম্বুক, ডিম পাহাড়, সাফাখুম, দেবতা পাহাড়, কেওক্রাডং, বগা লেক, সাজেক, সীতাকু-ের মতো পাহাড়গুলোয় পর্যটকদের ভ্রমণ বাড়ায় অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ শুরু হয়। যদিও এজন্য নেয়া হয়নি কোনো সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা নীতিমালা। অভিযোগ উঠেছে, পর্যাপ্ত পাহাড়ি পর্যটনের অভিজ্ঞতা না নিয়েই সাজেক কিংবা বান্দরবানের পাহাড়গুলোয় বিনিয়োগে আসছেন অনেকে। বিপুলসংখ্যক পর্যটক এলে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কী হবে সেসব বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই, যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড়গুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ।
ঠিক একইভাবে রাজধানী ঢাকার আশপাশে বনভূমি উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে রিসোর্ট। এসব রিসোর্ট থেকে ফেলা বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদী, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। গাজীপুরের শ্রীপুর রেঞ্জের সংরক্ষিত বনের জায়গা দখল করে অবাধে গড়ে তোলা হচ্ছে রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট। গত এক দশকে গাজীপুরে উজাড় করা হয়েছে কয়েক হাজার একর বনভূমি। শ্রীপুরে এক দশক আগেও বনভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার একর। এর মধ্যে চার হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু বেদখল হয়ে গেছে আরো ছয় হাজার একর বনভূমি।