নিজস্ব প্রতিবেদক:
সৃষ্টির অন্যান্য সকল জীবের চেয়ে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষ হলো সকল জীবের সেরা। সে হলো প্রকৃতি ও পরিবেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও বিবেচক জীব। কিন্তু এই বিবেকবান মানুষের দ্বারাই প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
মহাবিশ্বের লক্ষ্য কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে শুধু একটিই বাসযোগ্য গ্রহ আছে, আর তা হলো আমাদের এই পৃথিবী, এই বসুন্ধরা। হাজার রকমের রূপ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই বসুন্ধরাই আমাদের একমাত্র বসবাসের ঠিকানা। ৪.৫ মিলিয়ন বছরের প্রাচীন এই পৃথিবীতে আজ সাত বিলিয়নেরও বেশি মানুষের বসবাস। মানুষের কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর পরিবেশ আজ হুমকির মুখে।
পরিবেশের স্বাভাবিকতা বিনষ্টের অন্যতম একটি উপাদান হলো প্লাস্টিক। মানব সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পৃথিবীর পরিবেশ দূষণও। গত ৫০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং ব্যবহার বেড়েই চলছে। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউট’-এর মতে, ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী ২৬০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে এটির পরিমাণ বেড়ে ২৯৭.৫ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়। পৃথিবীতে প্রতিবছর মাথাপিছু প্রায় ৬০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। যেখানে উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোতে এর পরিমাণ ১০০ কেজির চেয়ে বেশি। গত ৫০ বছরে উৎপাদিত এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের ৩০ শতাংশ এখনও ব্যবহার হচ্ছে, ১২ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে; কিন্তু বাকি ৫৮ শতাংশের কোনো হিসাব নেই। হয়তো এই ৫৮ শতাংশের কিছু অংশ চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে আর কিছু মিশে গেছে মহাসাগরে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওটঈঘ : ওহঃবৎহধঃরড়হধষ টহরড়হ ভড়ৎ ঈড়হংবৎাধঃরড়হ ড়ভ ঘধঃঁৎব-এর মতে, উৎপাদিত প্লাস্টিকের ২ শতাংশ মহাসাগরে পতিত হয়।
বাংলাদেশের পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার পেছনেও বড় ভূমিকা পালন করে এই প্লাস্টিক। সূত্র জানায়, দেশে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয় প্যাকেজিং খাত থেকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্যাকেজিং খাত থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশ বা ১ লাখ ৮৩ হাজার ২০৪ টন বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। অন্যদিকে, ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩৮ টন প্লাস্টিক প্যাকেজিং বর্জ্য পরিবেশে উন্মুক্তভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ড্রেন এবং খালে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, মাটি ও পানির মানের অবনতিসহ প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের বিরূপ সমস্যা। দেশের উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন এবং পলিপ্রোপাইলিন (প্লাস্টিক দানা) উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় পোশাক রফতানিকারক দেশ। উৎপাদিত ৯২ শতাংশ পণ্যই রফতানি করা হয়। দেশে তৈরি পোশাক খাতের প্যাকেজিং থেকে উৎপন্ন প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ১৬ শতাংশ। এ খাতে পণ্যের প্যাকেজিংয়ে যে পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, তা থেকে উৎপাদিত বর্জ্য সম্পর্কে সে হারে সচেতনতা নেই।
ওয়েস্ট কনসার্নের এক তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় কম হলেও ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। প্রথমত, বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক খারাপ হওয়ায় পচনশীল এবং অপচনশীল বর্জ্য আলাদাকরণের সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। যার ফলে অপচনশীল প্লাস্টিক মাটিতেই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ নদীমাতৃক এবং নিম্নপ্রবাহের দেশ হওয়ায় উজানের পানির সঙ্গে প্রচুর প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে সাগরে পতিত হচ্ছে। যার ফলে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কম হলেও বিভিন্ন কারণে দূষণের মাত্রাটা বেড়েই চলছে। দৈনিক প্রায় দুই কোটি পলিথিন ঢাকা শহরে গড়ে ব্যবহার করা হয়। বাপার তথ্যমতে, বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে ১৩ ফুট পলিথিনের আস্তরণসহ ঢাকা শহরে মাটির নিচে এখনও ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
প্লাস্টিকের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো এটি অপচনশীল। প্লাস্টিক পদার্থের বিয়োজন খুবই কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। কিছু প্লাস্টিক পদার্থের বিয়োজিত হতে প্রায় হাজার বছরও লেগে যায়। যে জিনিসের বিয়োজিত হতে যত সময় লাগে সে জিনিসটি পরিবেশের জন্য তত বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর। বিভিন্ন ডোবা, নালা, খাল-বিল, ড্রেনে গিয়ে প্লাস্টিক পদার্থগুলো জমা হয়। যেহেতু এসব পদার্থ সহজে বিয়োজিত হয় না, তাই বৃষ্টির পর এসব পদার্থ পয়ঃনিষ্কাশনে প্রভাব ফেলে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকে, সেই সাথে বাড়ে রোগের প্রাদুর্ভাব। ডায়রিয়া, কলেরাসহ অনেক রোগে আক্রান্ত হয় শহরবাসী। জীবনযাপন হয়ে ওঠে আরো কষ্টসাধ্য।
পরিবেশ রক্ষায় সুষ্ঠু বর্জ্য নিষ্কাশনের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই ভবন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘সার্কুলার অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে বর্জ্য নিষ্কাশন ও রিসাইক্লিংয়ের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় শিল্পমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে আমাদের বৃত্তাকার অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক। বর্ধিত নগরায়ণের সঙ্গে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। শিল্প বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য, প্রাণিজ বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদি। এর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। ফলে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের ওপর জলবায়ুর প্রভাবের জন্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত, খাদ্যাভাবজনিত রোগসহ নানা জটিল ও অপরিচিত রোগ দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি ফেলে দেয়া ব্যাটারি, সেলফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশনসহ ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম (ই-বর্জ্য) থেকে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়েছে।
বর্তমানে প্রকৃতিতে চলছে শীতের দাপট। এই সময়টায় একসময় আমাদের দেশে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসতো। তাঁদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতো পাখিপ্রেমী মানুষ। কিন্তু এখন এদেশে পরিযায়ী পাখির আগমন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে। এখনই এসব পরিযায়ী পাখির প্রায় ৯০% এর পাকস্থলীতেই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৯% এ, যা এসব পাখির অস্বিত্বের পথে বিরাট বড় এক বাধা। এ পাখিরা বাঁচার জন্য সামুদ্রিক প্রাণীদের খেয়ে থাকে। যেহেতু সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ অত্যধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে, তাই সেসব সামুদ্রিক প্রাণী গ্রহণের সাথে সাথে সেসব পাখির পাকস্থলীতেও চলে যাচ্ছে প্লাস্টিক পদার্থগুলো।
এটি স্পষ্ট যে, বিশ্ব এখন বিরাট জলবায়ু সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশগত,অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উপর বিরাট এক ভূমিকা রেখে চলছে। প্লাস্টিককে প্রতিরোধ করতে না পারলে এই সংকট যে আরও ভয়াবহ হবে সে ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবেশবিদরা।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি