নিজস্ব প্রতিবেদক:
দীর্ঘদিন বিদেশে কর্মী যাওয়া কম থাকলেও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকদের বিদেশমুখী অভিবাসন। গত ডিসেম্বরে ১ লাখ ৩১ হাজার অভিবাসী কর্মী বিদেশের কর্মস্থলে যোগ দিতে যান। যাদের বেশিরভাগই ছিল স্বল্প দক্ষ। এটি ছিল বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ অভিবাসনের ঘটনা। এর আগে সর্বোচ্চ শ্রম অভিবাসনের রেকর্ড হয়েছিল ২০১৭ সালের মার্চে, সে সময় ১ লাখের কিছু বেশি কর্মী বিদেশে পাড়ি জমান। জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন কর্মী নিয়োগের লক্ষণীয় বৃদ্ধির সুবাদেই হচ্ছে এ উন্নতি। আর জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতির চাঙ্গাভাব, কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি এবং বিধিনিষেধের কড়াকড়ি শিথিল হওয়ায় বিদেশে কর্মসংস্থান প্রত্যাশীরা তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে যেতে পারছে। এছাড়া, সৌদি কোম্পানিগুলোতে অভিবাসী বাংলাদেশিদের নিয়োগের কোটা ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়ানোও এই রেকর্ড বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে বলেও জানান তারা।
এর আগে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারির চরম সংকট কালে মুখ থুবড়ে পড়ে বিদেশে চাকরির বাজার। তবে ২০২১ সালের আগস্ট নাগাদ তা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তারপর থেকেই অব্যাহত রয়েছে কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। ফলে প্রায় মহামারি পূর্ব সময়ের মাত্রায় ফিরছে জনশক্তি রপ্তানি। ২০২১ সালে প্রায় ৬ লাখ ১৭ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে চাকরি পেয়েছেন। মহামারির আগের বছর ২০১৯ সালে নতুন কর্মী নিয়োগের এ সংখ্যা ছিল ৭ লাখের বেশি। ভ্রমণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিধিনিষেধের কড়াকড়িতে ২০২০ সালে এই সংখ্যা মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজারে নেমে আসে বলে বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে। মহামারি হানা দেওয়ার আগে, প্রতি মাসে প্রায় ৬০-৬৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মী বিদেশ যেতেন, বেশিরভাগই যেতেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে। হক বছরে বাংলাদেশিদের জন্য শীর্ষ গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। মোট বৈদেশিক চাকরির ৭৪ শতাংশই হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে। এরপর যথাক্রমে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, সিঙ্গাপুর, জর্ডান ও কাতার। ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ সংখ্যক বা ৮৭ হাজার ২১২ জন কর্মী সৌদি আরবে যান। আমিরাতে যান ১৪ হাজার ৯২৬ জন। ওমানে ১৪ হাজার ৯২২, সিঙ্গাপুরে ৬ হাজার ৫৩৬, জর্ডানে ১ হাজার ৯৭১ এবং কাতারে গিয়েছেন ১ হাজার ৪৩০ জন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)- এর তথ্যানুসারে, ২০২১ দেশের মোট অভিবাসী কর্মীদের ৭৪ শতাংশই হলেন অদক্ষ। গত নভেম্বর পর্যন্ত বিএমইটি প্রদত্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে রামরু জানিয়েছে, ২০২১ সালে আধা-দক্ষ কর্মী রপ্তানিতে নিম্নগামী প্রবণতা দেখা যায়। এ সময় মোট বিদেশগামী কর্মীর ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ ছিলেন আধা-দক্ষ, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৪ শতাংশ। সে তুলনায় বেড়েছে অদক্ষ কর্মীদের বিদেশ যাত্রা। ২০২১ সালে ৭৪ শতাংশ স্বল্প-দক্ষ কর্মী দেশের বাইরে যান, যা ২০১৯ সালে ছিল ৪১ শতাংশ। ২০২১ সালে বিদেশ যাওয়া দক্ষ কর্মীর পরিমাণ ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৪৪ শতাংশ।
প্রবাসে কর্মী যাওয়ার হার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, মহামারিকালে ৪ লাখ অভিবাসন প্রত্যাশী দেশত্যাগ করতে পারেননি। এখন তারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছে। শ্রমিক অভিবাসনের প্রবণতা ধীরে ধীরে মহামারি পূর্ব অবস্থানে ফিরছে, যা আমাদের জন্য সুখবর। তিন বছর বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি বাংলাদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ায় আগামী মাসগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলেও আশাপ্রকাশ করেন তিনি। মহাপরিচালক আরও বলেন, বর্তমানে আমরা বেশিরভাগ অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করছি। তবে স্বাস্থ্য কর্মীসহ দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এনিয়ে আমরা কয়েকটি গন্তব্য দেশের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল বাশার জানান, অভিবাসন প্রত্যাসীদের টিকার আওতায় আনায় তাদের গন্তব্য দেশগুলোতে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে।
এদিকে বিদেশে শ্রমিক যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে প্রবাসী আয়ও। ডিসেম্বরে প্রবাসীরা ১৬২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। যা আগের মাস নভেম্বরের তুলনায় ৭ কোটি ডলার বেশি। ২০২১ সালের নভেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৫ কোটি ৩৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ৪৩ কোটি ডলার কম। ওই বছরের ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রবাসীরা ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে পাঠিয়েছেন ১৭২ কোটি ৬৭ ডলার। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে রেমিট্যান্স কমে যায় প্রায় ৮ কোটি ডলার। আবার আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স কমেছে ৯ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭২ কোটি ডলার। যা আগস্টে ছিল ১৮১ কোটি ডলার। একইভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসের তুলনায় আগস্টে রেমিট্যান্স কমেছে ৬ কোটি ডলার। জুলাই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮৭ কোটি ডলার। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ মাস জুনের তুলনায় প্রায় ৭ কোটি ডলার কম। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমতে শুরু করায় সরকার চলতি বছরের প্রথম দিন থেকেই রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়েছে। এখন থেকে প্রবাসীরা বৈধপথে (ব্যাংকিং চ্যানেলে) রেমিট্যান্স পাঠালে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন। যা ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ শতাংশ ছিল।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ