অনলাইন ডেস্ক :
আট বছর আগের কথা। দল হারিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি এদুয়াঁ মঁদি। একটা বছর পার করতে হয় ‘বেকার জীবন।’ তার ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়েই জাগে শঙ্কা। সেখান থেকে নাটকীয় পট পরিবর্তনে ধীরে ধীরে খুঁজে পান আলোর রেখা। ফেলে আসা সেই সময়ের পর তার গত এক বছরের অবিশ্বাস্য সব সাফল্য যেন রূপকথাকেও হার মানায়। গোলরক্ষক মঁদির স্বপ্নের এই অধ্যায়ে সবশেষ সাফল্যটা ধরা দেয় রোববার রাতে। জেতেন আফ্রিকান নেশন্স কাপের শিরোপা। ফাইনালে রেকর্ড সাতবারের চ্যাম্পিয়ন মিশরকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আফ্রিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি জয়ের অনির্বচনীয় স্বাদ পায় তার দেশ সেনেগাল। ম্যাচের শুরুতে পেনাল্টি মিস করে খলনায়ক হতে বসা সাদিও মানেই টাইব্রেকারে শেষ শটে গোল করে সব আলো কেড়ে নেন। তবে সেনেগালের এই সফল অভিযানে মঁদির অবদানকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। পেনাল্টি শুট আউটে চেলসির এই গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দেন মিশরের মোহামেদ লাশিনের শট। সেটিই মানেকে সুযোগ করে দেয় দলকে সিংহাসনে বসানোর। লিভারপুল ফরোয়ার্ড মানে জিতেছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। মঁদি হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক। গত মাসেই তিনি জেতেন ২০২১ সালের ফিফা বর্ষসেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার। অথচ আট বছর আগে তার জীবনেই নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার। মঁদির পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু হয় ফ্রান্স ফুটবলের চতুর্থ স্তরের দল শেরবোহের হয়ে। তিন বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষে ২০১৪ সালে তাকে ছেড়ে দেয় ক্লাবটি। শুর হয় তার কঠিন সময়। একে তো কোনো ঠিকানা নেই, তারওপর তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল তার এজেন্টও। তার বার্তার উত্তর দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিল ওই এজেন্ট। কোনো ক্লাব তাকে নিচ্ছিল না। ‘ফ্রি এজেন্ট’ হিসেবে কাটান একটি বছর। জীবিকা থমকে গিয়েছিল। কোনো উপায় না পেয়ে এক বন্ধুর কাছ থেকে কাপড়ের দোকানে কাজ করার প্রস্তাব পেয়ে সেটি প্রায় গ্রহণও করে ফেলছিলেন তিনি। ২০২০ সালে এক সাক্ষাৎকারে কঠিন সেই সময়ের কথা তুলে ধরেন মঁদি। “অবিশ্বাস্য কঠিন সময় ছিল সেটি। আমার সঙ্গী আমাদের প্রথম সন্তানের জন্মের অপেক্ষা করছিল। বেকার থাকাকালীন পাওয়া সহায়তা আমাদের জন্য যথেষ্ট হতো না। আমাদের আরও কিছুর দরকার ছিল, তাই আমি অন্য কাজ খুঁজতে শুরু করি।” অন্য চাকরি অবশ্য শুরু করতে হয়নি তাকে। তার কাছে আরেক বন্ধুর প্রস্তাব ছিল ভিন্ন। মার্সেইয়ের তখনকার গোলরক্ষক কোচ দমিনিক বের্নাতোভিক্সর বন্ধু ছিলেন মঁদির সাবেক ক্লাব শেরবোহের সতীর্থ, যিনি তাকে প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। তিনিই তাকে যোগাযোগ করিয়ে দেন দেন বের্নাতোভিক্সের সঙ্গে, যিনি একজন রিজার্ভ গোলরক্ষক খুঁজছিলেন। মার্সেইয়ে ট্রায়ালে টিকে যান মঁদি। অনুশীলনে দেখেই ওই কোচ বুঝতে পেরেছিলেন যে এক তারকার খোঁজ পেয়ে গেছেন তিনি। পরবর্তীতে দা গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের কথা বলেছিলেন বের্নাতোভিক্স। “প্রথম অনুশীলন সেশন থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সে (মঁদি) অন্যান্যের চেয়ে এগিয়ে।” ২০১৫-১৬ মৌসুমে ক্লাবটির ‘বি’ দলের হয়ে কয়েকটি ম্যাচ খেলেন মঁদি। বের্নাতোভিক্স তখন মঁদিকে এমন একজন এজেন্টে সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি তাকে লিগ টু’তে নিয়ে যেতে পারেন, যেন সে নিয়মিত খেলার সুযোগ পায়। ২০১৬-১৭ মৌসুমের শুরুতে তিনি যোগ দেন রাঁসে। ভাগ্যও ছিল সহায়। মৌসুমের প্রথম ম্যাচে রাঁসের গোলরক্ষক ইয়োহান কারাসকো পাঁচ মিনিট খেলার পরই লাল কার্ড দেখেন। মঁদি সুযোগ পেয়ে যান নিজের সামর্থ্য প্রমাণের। ২৬ বছর বয়সে তার লিগ ওয়ান অভিষেক হয়। ২০১৯ সালের অগাস্টে তিনি যোগ দেন রেনে। দলটিতে ছিলেন কেবল এক মৌসুম। সেই সময়েই তার পারফরম্যান্স নজড় কাড়ে সবার। ২০১৯-২০ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ক্লাবটির হয়ে তিনি খেলেন ৩৩ ম্যাচ। লিগ ওয়ানে তৃতীয় স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করা রেন প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। এই সাফল্যের পেছনে বড় অবদান ছিল মঁদির। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি পেয়ে যান বড় ঠিকানা। পাঁচ বছরের চুক্তিতে তাকে দলে টানে চেলসি। তখন ব্রিটিশ গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, তাকে কিনতে চেলসির খরচ দুই কোটি ২০ লাখ পাউন্ড। চেলসিতে এসে শুরুর একাদশে জায়গা পাকা করতে বেশি সময় লাগেনি মঁদির। কেপা আরিসাবালাগাকে পেছনে ফেলে তিনি হয়ে যান দলটির প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক। এক বছরের কম সময়ের মধ্য তিনি দলটির হয়ে জেতেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও উয়েফা সুপার কাপ। এবার সেনেগালের হয়ে জিতলেন আফ্রিকান নেশন্স কাপ। গত মে মাসে ম্যানচেস্টার সিটিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে মঁদি গড়েন দারুণ কীর্তিও। ইউরোপ সেরার প্রতিযোগিতাটির শিরোপা জেতা প্রথম আফ্রিকান গোলরক্ষক তিনি। সেই যাত্রায় তিনি ‘ক্লিন শিট’ রাখেন ৯ ম্যাচে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এক মৌসুমে যা সর্বোচ্চ। স্পর্শ করেন ভালেন্সিয়ার হয়ে সান্তিয়াগো কানিজারেস ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে কেইলর নাভাসের রেকর্ড। ২৯ বছর বয়সী মঁদির সামনে শিরোপা জয়ের হাতছানি আছে আরও। আগামী বুধবার আবু ধাবিতে ক্লাব বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে আল হিলালের মুখোমুখি হবে চেলসি। এ মাসেই লিগ কাপের ফাইনালে তারা খেলবে লিভারপুলের বিপক্ষে। তার বাবা গিনি-বিসাউয়ের আর মা সেনেগালের নাগরিক। মঁদির জন্ম আবার ফ্রান্সে। তিন দেশের যে কোনোটির হয়েই আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলার সুযোগ ছিল তার। ২০১৭ সালে আফ্রিকান নেশন্স কাপে তাকে খেলাতে চেয়েছিল গিনি-বিসাউ ও সেনেগাল দুই দেশই। আন্তর্জাতিক ফুটবলে পা রাখতে তিনি শেষ পর্যন্ত বেছে নেন মায়ের জন্মভূমিকে। দেশটির হয়েই তিনি পেলেন ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এই অর্জনকে মঁদি দেখছেন কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে। ফাইনালের পর ইন্সটাগ্রামে লিখেছেন, “কঠোর পরিশ্রম, ধারাবাহিকতা, ত্যাগ, বিশ্বাস, সমর্থন ও আশা। আমার দল, স্টাফ, সতীর্থ, পরিবার ও সমর্থকদের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা ও সমর্থন ছাড়া আমি এর কিছুই অর্জন করতে পারতাম না। আমরা সবাই মিলে জিতেছি।”
আরও পড়ুন
কানপুর টেস্টে মুমিনুলের সেঞ্চুরি, বাংলাদেশের সংগ্রহ ২৩৩ রান
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার বিয়য়ে যা বললেন তামিম
অক্টোবরে বাংলাদেশে সফরে আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা