নিজস্ব প্রতিবেদক:
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের আর্থিক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে রয়েছে। ওই টাকার কোনো দাবিদার নেই। বিভিন্ন ব্যাংক এবং পুঁজিবাজারে ওসব অর্থ পড়ে রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের ঠিকানা খুঁজে না পাওয়া, উত্তরাধিকারী জটিলতা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে ওই অর্থ ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেজন্য ব্যাংকগুলোর অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের আর্থিক খাতে দাবিদার নেই এমন অর্থের পরিমাণ ২১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের ২০ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা লভ্যাংশ দেয়া যায়নি। আর ব্যাংক আমানতের ১৩৫ কোটি টাকার কোনো দাবিদার নেই। আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ব্যাংকগুলোতে অনেক কারণেই কোনো কোনো হিসাবে দীর্ঘ সময় ধরে লেনদেন হয় না। তার মধ্যে গ্রাহকের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী যোগাযোগ না করলে, হিসাবে কোনো সমস্যা হলে, হিসাবটি কেওয়াইসি (গ্রাহককে জানা) অসম্পূর্ণ থাকলে এবং গ্রাহক ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ না করার কারণে ঘটে থাকে। ওসব হিসাবের অর্থ অদাবিকৃত অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। আর শেয়ার বাজারের শতাধিক কোম্পানির কাছে পড়ে রয়েছে ২০ হাজার হাজার কোটিরও বেশি টাকা।
সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টানা ১০ বছর ধরে লেনদেন হয় না এমন হিসাবে গ্রাহকদের প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা জমা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওসব অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অদাবিকৃত আমানত হিসাবে আনক্লেইমড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট জমা করেছে। ওসব হিসাবধারীর তালিকা সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। কোনো গ্রাহক বা তার উত্তরাধিকারী টাকা দাবি করলে ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এনে তা ফেরত দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ১০ বছর ধরে কোনো ব্যাংক হিসাবে লেনদেন না হলে এবং ওই আমানতের গ্রাহককে খুঁজে না পাওয়া গেলে সে অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে আনক্লেইমড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট নামে একটি হিসাব খোলা হয়েছে। ওই হিসাবে ব্যাংকগুলো ওসব টাকা জমা করে। প্রতিবছর ওই হিসাব হালনাগাদ করা হয়। ব্যাংকগুলোকে তাদের বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে বছরে একবার ওসব তথ্য পাঠাতে হয়।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের অদাবিকৃত লভ্যাংশের ২১ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২০৮টি কোম্পানিতে পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে বোনাস শেয়ারের মূল্য ১৯ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা এবং নগদ লভ্যাংশ ৯৫৬ কোটি টাকা। আবার দুই স্টক এক্সচেঞ্জের আলাদা হিসাবে ডিএসইর বিনিয়োগকারীদের ১১ হাজার ৭৪০ কোটি এবং সিএসইর বিনিয়োগকারীদের ৯ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিনিয়োগকারীদের বোনাস শেয়ার লভ্যাংশের পরিমাণ ১১ হাজার ১০৫ কোটি আর নগদ লভ্যাংশ ৬৩৫ কোটি। আবার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের বিনিয়োগকারীদের বোনাস লভ্যাংশের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮৮২ কোটি এবং নগদ লভ্যাংশ ৩২২ কোটি টাকা। আর একক কোম্পানি হিসাবে শুধু ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোতে পড়ে আছে ৮ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। বিএসইসি শেয়ারবাজারের বিপুল পরিমাণ ওই অর্থ কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ওই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে অর্থ দিয়ে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল নামে একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে। ওই ব্যাপারে কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। কোম্পানিগুলোর জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। তার আলোকে কোনো কোম্পানির লভ্যাংশ অনুমোদনের ৩০ দিনের মধ্যে বিও হিসাবে পাঠাতে হবে। আর অপরিশোধিত লভ্যাংশ একটি আলাদা সাসপেন্স হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে। আর লভ্যাংশ অনুমোদনের ৩ বছর পর অদাবিকৃত বোনাস ও নগদ লভ্যাংশ ‘বিএসইসির পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল’ নামে হস্তান্তর করতে হবে। ওই তহবিল থেকে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দেয়া হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে বিরোধ রয়েছে। কারণ ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশের অর্থ এ তহবিলে দিতে রাজি নয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা আর্থিক খাতে অদাবিকৃত অর্থ ব্যবহারে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতি জোর দিয়েছেন। তাদের মতে, দাবিদারহীন অর্থ বিতরণে প্রকৃত মালিক চিহ্নিত হওয়া জরুরি। লভ্যাংশের টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ কেউ না কেউ ওই টাকার মালিক। তারা কোথাও না কোথাও আছেনই। যাতে কোনো সময় প্রকৃত দাবিদার ফিরে এলে তাদের অর্থ পরিশোধ করা যায় তা নিশ্চিত করা জরুরি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ জানান, বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ওই অর্থ আসতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে নগদ লভ্যাংশের ৫০০ কোটি টাকার মতো বিএসইসির হাতে এসেছে। বোনাস শেয়ারও আসছে। আশা করা যায় ধীরে ধীরে সব চলে আসবে। ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা অবণ্টিত লভ্যাংশের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো নির্দেশনা দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এলে ব্যাংকের টাকাও আসবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি