নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকার ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কেনায় প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ভর্তুকি গুনছে। চলতি অর্থবছরে আইপিপি বাবদ ভর্তুকির জন্য ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রয়োজন পড়বে। আর বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেল ও গ্যাসের বর্তমান ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকলে ওই ভর্তুকির পরিমাণ আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই বিপুল অংকের রাজস্ব ব্যয় দুশ্চিন্তায় অর্থ মন্ত্রণালয়। মূলত আইপিপির কাছ থেকে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার কারণেই ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। চলতি বছর এ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ কোনোভাবেই ২০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। আর সামনের দিনগুলোয় তা আরো বাড়বে। তারপরও আরো বেশকিছু আইপিপি চলতি বছরেই কমিশনিংয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। তার সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার্য জ¦ালানির দামও এখন বাড়ছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের জন্য আইপিপির ভর্তুকি বাবদ অর্থ বিভাগে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি চাহিদা দিয়েছে। তবে অর্থ বিভাগ এখনো ওই অর্থ ছাড় করতে পারেনি। বিদ্যুৎ এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে ৭৮টি আইপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সব মিলিয়ে ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৮ হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট। যা মোট বিদ্যুৎ সক্ষমতার এক-তৃতীংশেরও বেশি। তাছাড়া আরো প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার আইপিপির বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। পিডিবি চলতি বছরে ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র কমিশনিং হওয়ার কথা জানিয়েছে। তার মধ্যে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে ধরা হচ্ছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এবং দ্বিতীয় ইউনিট আগস্টে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আর নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিট মেঘনাঘাট-২ নামে ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে সামিট পাওয়ার। বেসরকারি খাতে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলতি বছরের আগস্টে কমিশনিং হওয়ার কথা রয়েছে। ইউনিক গ্রুপ ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার আইপিপি খাতে আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। চলতি বছরের নভেম্বরে এটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। তার বাইরে চাঁদপুরে ১১৫ মেগাওয়াট, ঠাকুরগাঁওয়ে ১১৫ ও বরিশালে ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। পিডিবির কমিশনিং টাইম অনুযায়ী ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলতি বছরের জানুয়ারি, মার্চে চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সেগুলোর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসার পর আইপিপি বাবদ ভর্তুকির পরিমাণ আরো বাড়বে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বিপিডিবির ২০০ বিলিয়ন (২০ হাজার কোটি) টাকা ভর্তুকি হিসেবে প্রয়োজন হবে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৭১ শতাংশ বেশি। ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইএফএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও এই তথ্য উঠে এসেছে। মূলত বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ কেনায় ওই অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। বিশেষত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের মূল্যে অস্থিতিশীলতার কারণে সেখানেও বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ছে। আর বাড়তি ওই ব্যয় ইতোমধ্যে সরকারের অর্থ বিভাগকে চাপে ফেলেছে। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বাবদ শুরুতে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিপিডিবির বাড়তি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে তা এক দফায় আরো ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাতে বর্তমানে মোট বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্য থেকে গত অর্থবছরের মার্চ থেকে চলতি অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত মোট ছয় মাসের জন্য ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। গত সাড়ে ৬ বছরে সরকারকে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দকৃত ভর্তুকি যুক্ত করে ওই অঙ্ক ৫৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি দাঁড়ায়।
সূত্র আরো জানায়, বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বাজেটে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু পিডিবি প্রতি মাসেই মোটা অংকের ভর্তুকির চিঠি পাঠায়। তাতে বাজেটে বিদ্যুতের জন্য যে বরাদ্দ থাকে তা দিয়ে সংস্থাটির চাহিদা মেটে না। তাই পরবর্তী অর্থবছরের বাজেটের অর্থ দিয়ে আগের ভর্তুকির চাহিদা মেটাতে হয়। এবার যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা দিয়ে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়া সম্ভব হবে। তার পরের ৮ মাসের ভর্তুকির অর্থ সংস্থান আগামী বাজেটের বরাদ্দ থেকে করতে হবে। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটি বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ৪৯ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। তার মধ্যে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ওই হিসেবে সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয়কৃত অর্থের ৫৬ শতাংশেরও বেশি আইপিপিগুলোর পেছনে ব্যয় হয়েছে। তার আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) এর পরিমাণ ছিল অর্ধেকেরও কম। ওই সময় আইপিপি থেকে বিপিডিবি ১৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছিল। গত অর্থবছরে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির আর্থিক লোকসান হয়েছিল ১১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
এদিকে সরকার বিদ্যুৎ খাতের অপচয় কমাতে ইতোমধ্যে একবার পুরনো ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হলে বিপিডিবির সক্ষমতা বাবদ পরিশোধিত অর্থের পরিমাণ কমে আসবে এবং আর্থিক ক্ষতিও কম হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে সরকার ওই পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে এসেছে। বরং সম্প্রতি নতুন করে ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়নের অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বেসরকারি খাত থেকে বেশি বিদ্যুৎ কেনার কারণে বিপিডিবি প্রতিনিয়ত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। উৎপাদন খরচ কম এমন সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ওই ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সার্বক্ষণিক চালু রাখা প্রয়োজন। তাহলেই আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ নেয়া কমে যাবে। তবে আইপিপি থেকে সবসময় বিদ্যুৎ কেনা হবে এমন চুক্তিতেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হয়। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলে সেখানেও সরকারকে মোটা অংকের অর্থ গুনতে হয়।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ সচিব মো. হাবিবুর রহমান জানান, বৈশ্বিক পর্যায়ে কভিড মহামারী এবং বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ¦ালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ওই কারণে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণও একটু বেড়েছে। তবে এ মুহূর্তে ভর্তুকি কমাতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। যদিও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর জন্য মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে কখন তা বাড়বে সেটা বিইআরসির সিদ্ধান্ত। তাছাড়া অন্য যেসব উদ্যোগ নিলে ভর্তুকি কমানো সম্ভব, সেসব বিষয় নিয়েও কাজ করছে সরকার।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি