মইনুল হোসেন :
সংবাদপত্র ও স্বাধীনতা নিয়ে লেখা মানে জনগণের কথা বলার অধিকার নিয়ে লেখা। সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে মতবিরোধের মধ্যেও সহযোগিতা ও সহাবস্থানই হলো মানুষের জগৎ- চিন্তার জগৎ। চিন্তার জগতে মতপার্থক্য থাকবে না, তা কোনো চিন্তাশীল মানুষের কথা হতে পারে না। মানুষের কথা বলা বন্ধ করে রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ সুস্থ চিন্তার প্রয়োজনকে অস্বীকার করা। পাগলামির রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা।
দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মতপার্থক্যের মধ্যেও সহযোগিতা সৃষ্টি করা। জনগণের স্বার্থ ও নিরাপত্তা সমষ্টিগতভাবে শান্তি ও শৃঙ্খলার সাথে উপভোগের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। চিন্তার রাজ্যে পার্থক্য না থাকাটা চিন্তাহীন অসুস্থ মানুষের কথা। যিনি ভিন্নমতের মোকাবেলা করতে জানেন না তিনি রাজনীতিবিদ নন।
জনগণকে কথা বলতে বাধা-নিষেধ দিতে হবে, এটা কোনো শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার বক্তব্য হতে পারে না। মানুষকে অমানুষ বানিয়ে তার উপর অন্যায় অবিচার চালানো যায়। বাকস্বাধীনতা হরণ করে কোথাও কেউ সুখী ও নিরাপদ সমাজ গড়তে পেরেছে, তা আমার জানা নেই। ভোটের নয়, অস্ত্রের শাসন তো জনগণের বিরুদ্ধে শত্রুতার শাসন।
জীবনে বাঁচার জন্য অস্ত্রের মুখে নিরাপত্তাহীন চিন্তাশীল মানুষ কেন, জন্তু-জানোয়াররাও নিরাপদ দূরত্বে থাকে। অবশ্য কোনো পক্ষই নিরাপদে থাকে না। কথা বলার স্বাধীনতা বাধাপ্রাপ্ত হলে পেশিশক্তির সঙ্ঘাত বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। জেলখানায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দিজীবনের কথা ভিন্ন। কমিউনিস্ট দেশসমূহে সেরকম ব্যবস্থায় মুমূর্ষু ব্যক্তির মতো জীবনহীন ব্যবস্থা চালানো সম্ভব হচ্ছে। বেঁচে থাকার প্রশ্নটিকেই বড় বিষয় হিসেবে দেখা হয় মাত্র। তার অর্থ এই নয় সবাই যার যার অবস্থান থেকে সবকিছু মেনে নেবে।
মানুষ একে অপরের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে চিন্তা-ভাবনা আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে। মানুষ মাত্রই উন্নতমানের সমাজ নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা করে মিলে-মিশে বসবাস করতে চায়। বোবা থাকার জন্য মানুষ সৃষ্টি হয় নাই। মানুষ শুধু কথা বলে না, চিন্তা-ভাবনাও করে। বুঝতে হবে মানুষ যুক্তি-তর্কের ক্ষমতাসম্পন্ন জীব। সত্য-মিথ্যা সবকিছু মেনে নেয়া তার পক্ষে সম্ভবপর নয়।
একটু বিচার-বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, বিবেক-বিদ্যাবুদ্ধিহীন লোকরাই ক্ষমতা-পাগল একনায়কত্বের স্রষ্টা। চিন্তাশীল সঠিক নেতৃত্বের অভাবে একটি জাতির কি বিপর্যয় হতে পারে সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব শিক্ষিত লোকদের। শিক্ষা ও জ্ঞান কোনোটা সোনা-দানার মতো সম্পত্তি নয় যে তা লুকিয়ে রাখতে হবে। শত্রু খোঁজাই স্বৈরশাসকদের রাজনীতির প্রধান করণীয় বিষয়।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের অর্থ সবাইকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা। জনগণকে কথা বলতে না দেয়া, কথা বলতে দিলে শত্রু হয়- এ শিক্ষা কমিউনিস্টদের। কমিউনিস্ট সরকার এই চিন্তায়ই ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে যে তারা শত্রুবেষ্টিত।
জনগণের পক্ষে কথা বলার অধিকারই সাংবাদিকতার অধিকার। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকার অর্থ সমগ্র জাতিকে বাকরুদ্ধ করে রাখা। কথা বলাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। ভিন্নমত পোষণ করা আইনের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ হতে পারে না। মতামতের ভিন্নতা প্রকাশ করা ভয়-ভীতি দেখিয়ে বন্ধ রাখা যেতে পারে। কিন্তু মানুষের মতামতের ভিন্নতা বন্ধ করা যাবে না। ভিন্ন মতামত তৈরি হতে পারলে প্রকাশও হতে পারবে।
কথা বলার ব্যবস্থা শাসনতন্ত্র ও আইন দ্বারা রক্ষা করা হয় সঙ্ঘাত-সংঘর্ষমুক্ত সমাজগঠনের জন্য, শান্তি ও সুখী সমাজ গঠনের জন্য। কথা বলার অধিকার কোনো ব্যক্তির দেয়া অধিকার নয়। মানুষ কথা বলবেই, কোনো না কোনোভাবে প্রতিবাদ করবেই।
কোনো কোনো এমপি এখন বলছেন যে, রাজনীতিবিদরা দেশ চালাচ্ছেন না। দেশ শাসন করছেন আমলারা। রাজনীতিবিদদের হাতে শাসনব্যবস্থা নাই। এত বছর পর তারা এ সহজ সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এমপি সাহেবরাও তো আমলাদের সাহায্যে নির্বাচিত হচ্ছেন। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে জনাব তোফায়েল আহমেদের অজানার কথা নয়।
জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্র ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত এটাই রাজনীতিবিদদের পরিচয় ও শক্তি। শাসনতন্ত্র অমান্য করে, নির্বাচন চুরি করে রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব হারিয়েছেন বহু পূর্বেই। কবে আর কত দিনে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার কর্তৃত্ব ফিরে আসবে তা এখন আর রাজনীতিবিদরা নির্ধারণ করতে পারবেন না। নতুন নেতৃত্ব এবং অবস্থার মূলগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। রাজনীতিতে এখন এমন লোকদের সমাগম হয়েছে যাদের অনেকের পক্ষে শালীন ভাষায় কথা বলাই অসম্ভব। দেশে চলছে নবীনদের মস্তানি রাজনীতি। তাদেরকে ভয় করে চলতে হবে। রাজনীতিবিদরা আমাদের সমর্থন চায় না।
একনায়কত্বকে দেখা হয় ভয়-ভীতির ব্যবস্থা হিসেবে। এ ব্যবস্থায় একে অপরকে দেখা হয় ধ্বংসের ও ষড়যন্ত্রের প্রতিযোগী হিসেবে। একনায়কত্বের ধ্বংস হঠাৎ করেই আসে। তাদের সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা হলো কখন সেই ‘হঠাৎ সময়টি’ আসবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় ব্যর্থ রাজনীতিবিদদের পুনর্বাসন হবে।
বাংলাদেশে সুস্থ শাসনতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমঝোতার চেষ্টা অনেক হয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হতে পারে নাই। বাংলাদেশে চলছে সম্মিলিত দুর্নীতির অপশাসন। তাই পরিস্থিতি পরিবর্তনে সমঝোতা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। রাজনীতিবিদরা বহুদিন থেকে ব্যবসায়ী বনে গেছেন। আগে তো তাদের রাজনীতিবিদ হতে হবে। জানতে হবে সরকার পরিচালনার অর্থ কি।
আমাদের সামনে বর্তমান যুগের এত দৃষ্টান্ত থাকতেও ক্ষমতার নেশাগ্রস্ত একনায়করা পুলিশি অস্ত্র শক্তির উপর নির্ভর করে চলেছেন। ইরানের শাহ কত ধরনের গোপন বাহিনী তৈরি করেছিল। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বিরাট সামরিক বাহিনী সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু যখন পতন এলো তখন সবাই তাকে মৃত ইঁদুরের মতো ছুড়ে ফেলে দিলো। দেশ থেকে তাকে পালাতে হলো। লিবিয়ার গাদ্দাফি রাস্তার পাশে গুহার মধ্যে পালাতে গিয়েও রক্ষা পায়নি। রাস্তার কুকুরের মতো তাকে হত্যা করা হয়েছে। কোনো ক্ষমা চাওয়া কাজ করেনি। হিটলারের মতো পৃথিবী কাঁপানো একনায়ককেও স্ত্রীসহ নিজের গুলিতে নিজেদের জীবন হারাতে হয়েছে। তার নিজের রক্ষার জন্য যে বাহিনী সেই বাহিনীই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, তাকে জীবনে শেষ করার জন্য। ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটর মুসোলিনিকে হত্যা করে রাস্তায় টেনে নিয়ে জনগণ ফুর্তি করেছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে চতুর্থবারের জন্য নির্বাচনে জয়ী করার জন্য প্রচুর জনসমর্থন ছিল। তিনি তাদের এই বলে বুঝালেন যে, ক্ষমতায় বেশিদিন থাকলে ক্ষমতায় থাকার নেশা ধরে যাবে। তিনি বলতে চেয়েছেন ক্ষমতায় থাকাটা নেশায় পরিণত হলে তার পক্ষে সুস্থ চিন্তা-ভাবনা করা সম্ভব হবে না। ক্ষমতার নেশা যাকে পায় সে সর্বদা ক্ষমতায় থাকার কথাই ভাবে। দেশ কোথায় গেল তা ভাববার সুস্থ চিন্তা তার থাকে না।
এমন একনায়ক পাওয়া যাবে না যে চাটুকারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকাকে প্রশ্রয় দেননি। সকল একনায়কের ধ্বংসের কাজ বেশি করেছে তার স্তাবকরা, শত্রুরা নয়- এটা ঐতিহাসিক সত্য।
চাটুকারদের নির্বুদ্ধিতার কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও নেতৃত্ব ধ্বংসের পথে গিয়েছে। সব হারিয়ে তারা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি গণতন্ত্রবিরোধী চেতনা? সত্য-মিথ্যা ও প্রতারণার ঘুরপাকে আমরা আজ দিশেহারা।
আমি অস্বীকার করবো না যে আমাদের বিপর্যয়ের জন্য আমাদের শিক্ষিত লোকদের নীরব স্বার্থপর ভূমিকা অনেক দায়ী। আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা যখন জাগ্রত এবং ব্যস্ত তখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধি নিয়ে ঘুমিয়ে নিস্তেজ হয়ে থাকলেন। তাদের মাথায় কাজ করলো না যে, ছলচাতুরী থেকে বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনকে রক্ষা করার নেতৃত্ব আমাদের হাতে থাকুক। চাকরিজীবী হওয়ার শিক্ষা কোনো জ্ঞান-বুদ্ধি অর্জনের শিক্ষা নয়- কেরানিগিরির শিক্ষা। সেটাই প্রমাণিত হলো।
মানিক মিয়া পূর্ণাঙ্গভাবে সাংবাদিক ছিলেন। যারা সাংবাদিকতার স্বাধীনতার কথা বলেন তারা কি মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আব্দুস সালাম সাহেবদের কথা মনে রেখেছেন? সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি দলীয় রাজনীতির সুবিধা নেয়ার জন্য সাংবাদিকরা নিজেদের শক্তি ও মর্যাদা হারিয়েছেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা জনগণের কথা বলার স্বাধীনতা। তাই সাংবাদিকরা কে কি করলেন বা করলেন না সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে আমি বলবো না। মানা হোক বা না হোক দেশে এখনও একটি শাসনতন্ত্র আছে। তাতে মানুষের কথা বলার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভেতরে ভেতরে এমন একধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা চলছে যে কারণে মানুষের কোনো অধিকারেরই নিশ্চয়তা নাই। কাউকে আইনের আওতায় আনার অর্থ সরকারের জন্য তাকে পুলিশের আওতায় আনা। আর পুলিশ ধরলে তার জেল অনিবার্য। অর্থাৎ জজ সাহেবদের বিচারের পূর্বেই শাস্তি শুরু হয়ে যায়। আমাদের ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তদেরকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বে পুলিশি বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব বিচার বিভাগকেই পালন করতে হয়। আইনেই বলা আছে কোর্টের বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত সে নির্দোষ। আমাদের বিচারব্যবস্থায় জামিন পেতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হয়। এ ব্যবস্থা যে কত নিষ্ঠুর তা আমরা কতজন ভাবছি?
পাঁচ-ছয় বছর গুম থাকার পর জীবিত ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে। আবার অনেকে চিরদিনের জন্য গুম হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের কারণে কাগজে লেখা আইন মানুষের কোনো কাজ করছে না, কোনো অধিকারই অধিকার হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। সবাইকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হচ্ছে।
আমাদের অতীত যতই ব্যর্থতার নির্বুদ্ধিতায় আচ্ছন্ন থাকুক না কেন, আমরা নিশ্চয়ই একটি বোবা জাতির পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে চাই না।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী,
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক