নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশের আটটির মধ্যে সাতটি বিভাগেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের সাতটি বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৫০টি নমুনায় ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বি ১৬১৭ পাওয়া গেছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণে জর্জরিত এখন পুরো দেশ। চলতি মাসের প্রথম নয়দিনে মারা গেছেন ১ হাজার ৫০১ জন আর আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ২৮৫ জন। আর ইতোমধ্যে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বর্তমান সংক্রমণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জুলাই নতুন করে ৮ হাজার ৩০১ জনের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এরপর ২ জুলাই ৮ হাজার ৪৮৩ জন, ৩ জুলাই ৬ হাজার ২১৪ জন, ৪ জুলাই ৮ হাজার ৬৬১ জন, ৫ জুলাই ৯ হাজার ৯৬৪ জন, ৬ জুলাই ১১ হাজার ৫২৫ জন, ৭ জুলাই ১১ হাজার ১৬২ জন এবং ৮ জুলাই ১১ হাজার ৬৫১ জন এবং ৯ জুলাই ১১ হাজার ৩২৪ জন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ গত আটদিনে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ২৮৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত এক সপ্তাহে রোগী বাড়ে ৫০ শতাংশের বেশি। তার আগের সপ্তাহে ৩৫ হাজার রোগী শনাক্ত হলেও পরে তা ৫৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তার সঙ্গে মৃত্যু বেড়ে যায় ৪৬ শতাংশ। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে হাসপাতালে খালি বেড আর আইসিইউ’র সংখ্যা। তাছাড়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ সারাদেশের ১৫ হাসপাতালে ভর্তি আছেন শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত রোগী। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, নওগাঁ, নোয়াখালী, পাবনা, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও জেলাতে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনায় ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই জেলাগুলো দেশের সাতটি বিভাগের অন্তর্গত। গত ৩ ও ৪ জুলাই বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) জিআইএসএআইডিতে ১৭টি জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য আপলোড করেছে। সেখানে তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, নওগাঁতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত নমুনা পাওয়া গেছে ১১টি, বাকিগুলো পাওয়া গেছে চাপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা এবং ঢাকায়। এর আগে গত ১ জুলাই আইইডিসিআর ৩৬টি জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য আপলোড করে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৬টি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই পাওয়া গেছে সিলেট থেকে সংগ্রহ করা নমুনায়। দেশে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বি ১৬১৭-এর সামাজিক সংক্রমণের কথা আগেই জানিয়েছিল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। গত ৩ জুন প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন পর্যায়ে জিনোম সিকোয়েন্স করে জানায়, সারাদেশে ৫০টি নমুনার মধ্যে ৪০টিতে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, যা শতকরা হিসাবে ৮০ শতাংশ। চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গত ২৬ জুন আপলোড করা জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাদের প্রাপ্ত ছয়টি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে পাঁচটি ঢাকা বিভাগে এবং একটি কুষ্টিয়ায়। ঢাকা বিভাগের মধ্যে আছে ঢাকা, টাঙ্গাইল এবং কিশোরগঞ্জ। ২১ জুনে আপলোড করা আইসিডিডিআরবি’র জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য বলছে, তারা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছে ৩৪টি নমুনায়। এর মধ্যে ১৬টি নমুনা ঢাকার। ঢাকার মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মধুবাগ ও মহাখালী এলাকার পাশাপাশি রাজবাড়ী এবং শরীয়তপুর আছে এই তালিকায়। তাছাড়া খুলনা, যশোর এবং রাজশাহী আছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া জেলার মধ্যে। এ পর্যন্ত ঢাকায় পাওয়া ৩৭টি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তথ্য সেখানে জমা আছে। আর সারাদেশের আছে ৯৫টি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তথ্য। সর্বশেষ গত ৪ জুলাই আইইডিসিআর জানায়, বাংলাদেশে গত এপ্রিলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের শনাক্তের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট মে মাসে ৪৫ শতাংশ ও জুন মাসে ৭৮ শতাংশ নমুনায় শনাক্ত হয়। বর্তমান দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সুস্পষ্ট প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। আইইডিসিআর বলছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিকোয়েন্স করা সকল নমুনায় আলফা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়। মার্চ মাসে সিকোয়েন্সকৃত মোট নমুনার ৮২ শতাংশ বিটা ভ্যারিয়েন্ট ও ১৭ শতাংশ আলফা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এপ্রিল মাসেও বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের মধ্যে বিটা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য ছিল। আইইডিসিআর জানায়, কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষায় প্রাপ্ত ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কিত তথ্য জিনোম সিকোয়েন্স এর বৈশ্বিক ডাটাবেজে জিআইএসএ আইডিতে জমা দেওয়া হয়ে থাকে। যে ধরনের ভ্যারিয়েন্টই হোক না কেন, তা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণই করাই একমাত্র উপায়। এর সঙ্গে কোভিড-১৯ টিকা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন নেওয়া প্রয়োজন। দেশের চলমান লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ অমান্য করার ঘটনা ঘটছে। এতে করে রোগী সংখ্যা যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায় তাহলে আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরর রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা নাজমুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণের উচ্চমুখী এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, জুলাইয়ে রোগী সংখ্যা এপ্রিল ও জুন মাসকে ছাড়িয়ে যাবে। লকডাউন বা বিধিনিষেধ অমান্য করার কারণে রোগীর সংখ্যা যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাহলে আমরা আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বিশ্বের ৯৮টি দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সরকারের পাবলিক হেলথ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতে যেরকম আচরণ করেছে, এখানেও ঠিক তাই করছে। মানুষকে অধিকহারে সংক্রমিত করছে। আবার অনেকেই সংক্রমিত হয়ে বাড়িতেই থাকছেন। সংক্রমিত হওয়ার পর বুঝতে পারছে না, হাসপাতালে আসতেও দেরি করে ফেলছেন, যার ফলে দ্রুত মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে। এখন আমাদের দেশের সর্বত্রই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম