নিজস্ব প্রতিবেদক :
করোনা সংক্রমণের কারণে দুই সপ্তাহের লকাডাউন শেষে গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে দূরপাল্লার গণপরিবহন। শুক্রবার (১৬ জুলাই) দ্বিতীয় দিনে যাত্রী চাপ বেড়ে যায় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সংক্রমণের ঝুঁকির মুখেও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে অনেকেই রাজধানী ছাড়ছেন।
আবার অনেকেই বাস কাউন্টারগুলোতে ভিড় করছেন ঈদের আগের দুদিনের টিকিটের জন্য। অন্যদিকে একসঙ্গে এত মানুষ ঢাকা ছাড়ার কারণে করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কার পাশাপাশি বেড়ে গেছে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে গাড়ির চাপ। এতে দীর্ঘ এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র যানজট। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, ছুটির দিন হওয়ায় টার্মিনালে যাত্রীর চাপ। কাউন্টারগুলোর সামনে বাসের অপেক্ষা করছেন ইতোমধ্যে টিকিট সংগ্রহ করা যাত্রীরা। তাদের অধিকাংশের মুখেই মাস্ক দেখা গেছে। আবার অনেক যাত্রীকেই ঈদের দুদিন আগের টিকিটের প্রত্যাশায় কাউন্টারগুলোতে ভিড় করছেন।
বিকেল নাগাদ এই চাপ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছিলেন কাউন্টার সংশ্লিষ্টরা। বাস টার্মিনালে অপেক্ষারত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি প্রায় সকলের জানা রয়েছে। তবে তারপরও ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন ঈদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে। এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা বিভিন্নভাবে, এমনকি ভেঙে ভেঙে গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। গণপরিবহন ছেড়ে দেওয়ায় তাদের মধ্যে স্বস্তিও দেখা গেছে। সন্তানকে দেখতে রাজধানীতে এসেছিলেন বৃদ্ধ রাবেয়া খাতুন ও আসলাম মিয়া। ঢাকায় এসে লকডাউন এর কারণে আটকে গিয়েছিলেন তারা। গণপরিবহন ছাড়ার খবরে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে রাজধানী ছেড়ে যাচ্ছেন এই দম্পতি। তবে যাওয়ার সময় কিছুটা ভোগান্তির অভিযোগ করলেন তারা। আসলাম মিয়া বললেন, চুয়াডাঙ্গা পরিবহন বাসের টিকেট কেটেছি। সকাল ৯টায় ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর পর্যন্ত বাসের দেখা মেলেনি। বাড়ি যেতে হবে, তাইতো কিছুটা কষ্ট সহ্য করেও অপেক্ষা করছি। তামজীদ নামের এক যুবক গাবতলী বাস টার্মিনাল এসেছিলেন অগ্রিম টিকেট কিনতে।
আগামী ১৯ জুলাই গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য অগ্রিম টিকেট নামের সোনার হরিণটা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। টিকিট পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত তামজিদ নিশ্চিন্ত মনে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন কাউন্টার থেকে। তিনি বলেন, পরিবারের সাথে ঈদ শেষ করে লকডাউন এর আগেই চলে আসার চেষ্টা করবো। পরিবারের এক সদস্যকে গ্রামে পাঠাতে রবিউল নামের আরেকযুবক এসেছেন অগ্রিম টিকেট কাটতে। কমফোর্ট পরিবহনের ১৭ তারিখের একটি টিকিটও পেয়েছেন তিনি। তবে এখনও শঙ্কা কাটেনি তার। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ঘাটে যে দীর্ঘ যানজটের কথা শুনতে পাচ্ছি তাতে বাড়িতে পৌঁছানো কত সময় লাগে তা নিয়েতো কিছুটা শঙ্কা রয়েছেই। এ এস এন্টারপ্রাইজ পরিবহনের মালিক আসাদুজ্জামান এরশাদবলেন, কিছুটা চাপ রয়েছে। তবে গাড়ি আসতে দেরি হওয়ার কারণে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ঘাটে জ্যাম থাকার কারণে যেসব গাড়ি রাতেই ফিরে আসার কথা সেসব গাড়ি আসবে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার আলমগীর বলেন, আমাদের পরিবহনের অগ্রিম টিকেট বেশি বিক্রি হচ্ছে। ঈদের একদিন আগে টিকেট নাই বললেই চলে। ১৯ এবং ২০ তারিখের টিকিটের চাহিদাই বেশি রয়েছে।
এদিকে বাড়িফেরা মানুষের সঙ্গী হয়েছে যানজটের ভোগান্তি। ঢাকা থেকে বের হওয়ার সব সড়ক-মহাসড়কেই গাড়ির চাপ। জানা গেছে, সাভারের বিভিন্ন মহাসড়কে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই শুরু হয় যানজট। বেলা যত বাড়ে ততই দীর্ঘ হয় যানবাহনের সারি। যানজট ও গরমে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী ও কোরবানির পশুব্যবসায়ীরা। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে এসব সড়কে তীব্র যানজটের চিত্র দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের ১৬ কিলোমিটার, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নবীনগর থেকে হেমায়েতপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার ও আব্দুল্লাহপুর-বাইপাল সড়কের বাইপাল থেকে ধৌড় পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন স্থানে যানবাহনের জটলা লেগে আছে। সড়কে থেমে থেমে চলছে পরিবহন। সাভার ট্রাফিক ইনস্পেক্টর (টিআই) রবিউল ইসলাম বলেন, সাভারের সব রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক চেষ্টা করে এখন যানজট কিছুটা কমাতে পেরেছি। ট্রাফিক পুলিশের সব সদস্যের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত গাড়ির চাপ ও ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে গরুর গাড়ি ঢুকছে ও এক-দুইদিনের ভেতর পোশাক কারখানাগুলোর ছুটি হবে। তাই আগেই মানুষ বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছে। তবে যানজট নিরসনের সব চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট: কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের দ্বিতীয় দিনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। যানজটের প্রভাব রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের সড়কে পড়ে। গতকাল শুক্রবার সকালে যানজটের সৃষ্টি হলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। এতে করে কাকলী, বনানী, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট, আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত তীব্র যানজট দেখা যায়। এ সময় বাসের যাত্রী ও পথচারীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেকে বাধ্য হয়ে বাস থেকে নেমে হেঁটেই রওনা দেন গন্তব্যের পথে। তবে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। পুলিশ জানায়, ঈদের আগে ঘরমুখো যাত্রীর চাপ বাড়ায় সকাল সাড়ে আটটার পর থেকেই যানজট শুরু হয়। জানা গেছে, লকডাউন শিথিলের প্রথম দিন গত বৃহস্পতিবার রাজধানী জুড়ে ছিল যানবাহনের চাপ। কোথাও কোথাও ছিল যানজট। কিন্তু গতকাল শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন সত্ত্বেও ময়মনসিংহমুখী সব যানবাহন সড়কে আটকা পড়েছে। ট্রাফিক পুলিশ ও যানবাহন চালকদের মতে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এয়ারপোর্ট থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত চলছে বিআরটি প্রকল্পের কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে সড়কে তৈরি করে রাখা হয়েছে গর্ত, ফেলে রাখা হয়েছে বালু-মাটিসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী। পুরো সড়কই এখন খানাখন্দে ভরা। এসব কারণে যানবাহন চলাচল করতে না পেরে প্রতিদিনই সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এর মাঝে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে যানজটের সৃষ্টি হলে তা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীতে। রাজধানীর বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট, আজমপুর ও আব্দুল্লাহপুর এলাকায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পরিদর্শকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল থেকেই গাজীপুরে সৃষ্টি হওয়া যানজট চলে যায় রাজধানীর মহাখালী পর্যন্ত। এর মধ্যে আব্দুল্লাহপুর থেকে প্রায় বনানী পর্যন্ত সড়ক জুড়েই এখন যানজট। সকাল থেকেই যানবাহনগুলো চলাচল করছে খুব ধীরগতিতে। গাজীপুর যেতে বাসা থেকে বের হওয়া কামরুল ইসলাম বলেন, আমি সকাল ৮টা ১০ মিনিটে তেজগাঁও স্টেশনে একটা লোকাল ট্রেন মিস করার পর সাতরাস্তা এসে সাড়ে আটটার দিকে বাসে উঠলাম। প্রথমে ভালোই চলছিল। ফাঁকা রাস্তায় একটানে কাকলী-বনানী চলে আসি। কিন্তু কাকলী থেকে আর্মি স্টেডিয়ামের সামনের ব্রিজে ওঠার পর গাড়ি স্লো হয়ে গেল। তিনি আরও বলেন, সেই পৌনে আটটা থেকে বাসে বসে আছি। ৫ থেকে ১০ ফুট আগায় আবার থামে। খিলক্ষেত আসতেই পৌনে ১০টা বাজল। ভূঁইয়া পরিবহনের চালক মুসা মিয়া বলেন, ৯৫০ টাকা দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসার্ট থেকে বুধবার বিকেলে রওয়ানা দিলাম। ডাইরেক্ট গাড়িতে ভাড়া বেশি দিয়ে ঢাকা যাচ্ছি। কারণ সকাল থেকে গাড়ি চালাব। কিন্তু যানজটে আটকা পড়ছি। যানজটে আটকে থাকা বাসের এক চালক বলেন, সিরাজগঞ্জ থেকেই জ্যামে পড়লাম, যেখানে আসার কথা ভোরে সেখানে ঢাকা পৌঁছলাম ১০টার পর। গতকাল জ্যাম ছিল, আজও একই অবস্থা। গাড়ি নিয়ে বের হলাম প্রথম যাত্রায় সকাল থেকেই জ্যাম। খিলক্ষেত পুলিশ বক্সের পরিদর্শক বলেন, আমরা সকাল থেকেই চেষ্টা করছি যানবাহনগুলোর গতি ধরে রাখতে। কিন্তু সামনের (গাজীপুর) লাইন পরিষ্কার না থাকায় কোনোভাবেই তা পারছি না। এসব কারণে যানবাহনগুলো চলছে ধীরগতিতে। মাঝে কিছু সময়ের জন্য গাড়ির গতি বাড়লেও মুহূর্তেই তা থেমে যাচ্ছে। এ কারণে যাত্রীরা পড়ছেন ভোগান্তিতে।
চট্টগ্রামগামী গণপরিবহনের তীব্র চাপ: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনায় দীর্ঘ এলাকা জুড়ে যানজট দেখা দেয়। চট্টগ্রামমুখি গণপরিবহনের তীব্র চাপে এ যানজটের সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে শুরু হওয়া এ যানজটে ভোগান্তিতে পড়ে রোগীসহ ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষ। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড থেকে ঊষা জুট মিল পর্যন্ত মহাসড়কের দুইপাশে অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যানজটে আটকা পড়েছে শত শত যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহন। এতে করে দুর্ভোগে পড়েছে ঘরমুখো হাজার হাজার মানুষ। যানজট নিরসনে সকাল থেকে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। তাদের দাবি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মুখি পরিবহনের অতিরিক্ত চাপ ও পথচারীরা মহাসড়ক পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করায় এ যানজটের সৃষ্টি হয়। নোমান নামে তিশা পরিবহনের এক যাত্রী বলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চান্দিনায় যানজটে আটকে আছি। এতে করে বাচ্চাদের নিয়ে খুব ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সাইফুল ইসলাম নামের আরেক যাত্রী বলেন, অসুস্থ মাকে নিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় রওয়ানা দিই। চান্দিনায় গিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে। পরে কোনোমতে পুলিশের সহায়তায় মুক্তি মেলে। মহাসড়কের ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মিঠুন বিশ্বাস বলেন, যানজট নিরসনে সকাল থেকে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে। দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ওসি জহুরুল হক বলেন, মহাসড়কে গাড়ির তীব্র চাপ থাকলেও দাউদকান্দির অংশে সকাল থেকে যানজট মুক্ত রয়েছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম