November 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, July 23rd, 2021, 8:08 pm

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়লেও লোডশেডিং-বিভ্রাট থেকে রেহাই মিলছে না

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক :

দেশে আশানুরূপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু তারপরও লোডশেডিং-বিভ্রাট থেকে গ্রাহকরা রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাগজপত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকা এবং এর ফলে গ্রাহক ভোগান্তির ও ক্ষতির কোনো তথ্য নেই। বর্তমানে দেশে ২১ হাজার ৪৭৪ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহ গড়ে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে গ্রাহকের কাছে যা লোডশেডিং, বিতরণ সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে তা লোড ম্যানেজমেন্ট। আর বিদ্যুতর আসা-যাওয়াকে সরকারি সংস্থাগুলো বলছে কারিগরি ত্রুটি বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ফলে গত এক যুগে সরকারের অন্যতম বড় ও সেরা অর্জনের প্রতি জনগণের একটি বড় অংশ আস্থা হারাচ্ছে। এমনকি স্থিতিশীল ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না পেয়ে নিজস্ব ক্যাপটিভ বিদ্যুতের উপরই শিল্পমালিক-উদ্যোক্তারা ভরসা রাখছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে চালু থাকা ১৪১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৪৭৪ মেগাওয়াট। আর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ যাচ্ছে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, যতোটুকু চাহিদা ততোটুকুই বিদ্যুৎ বিতরণ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দৈনিক উৎপাদন রিপোর্ট অনুযায়ী গত সাড়ে ৬ মাসে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়েছে। কোনো লোডশেডিং হয়নি।
সূত্র জানায়, চলতি জুলাই মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখে দেশের ৬টি বিভাগে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা বা সরবরাহ ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট থেকে ১২ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াটের মধ্যে ছিল। উৎপাদন ক্ষমতা সরবরাহকৃত পরিমাণের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ থাকা সত্ত্বেও দেশের সব জেলার গ্রাহকদেরই অভিযোগ- এ সময়কালে এলাকাভেদে প্রায় প্রতিদিনই ১০ মিনিট থেকে ৫ ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যায়নি। বরং বিদ্যুৎ বিভ্রাট গ্রাহকদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তের বা এক মিনিটের মধ্যে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে অনেক ইলেক্ট্রিক, ইলেক্ট্রনিক এবং শিল্প যন্ত্রপাতির ক্ষতি হচ্ছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) আওতাধীন এলাকায় কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন ৪-৫ বার করে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে। আর প্রতিবারে বিদ্যুৎহীন থাকার পরিমাণ প্রায় ১৫ মিনিট। তাছাড়া ডেসকোর আওতাধীন মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায় প্রতিদিন অন্তত দু’বার করে লোডশেডিং হচ্ছে। রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজমান। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি বা আরইবি দেশে লোডশেডিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করছে। তবে সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতাধীন অনেকগুলো জায়গায় বর্তমানে ৩৩০ মেগাওয়াটের লোডশেডিং চলছে। সামিটের ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি (এফএসআরইউ) রক্ষনাবেক্ষণে থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আগে অবহিত করা হয়নি।
সূত্র আরো জানায়, দেশের ৪ কোটি বিদ্যুৎ গ্রাহকের মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটির ৮০টি সমিতির (পবিস) আওতায় ৩ কোটি ১৩ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছে। তবে আরইবির দাবি- রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে সমস্যা রয়েছে। বড় সমস্যা লো-ভোল্টেজ। কক্সবাজারে রেললাইন উন্নয়ন-সম্প্রসারণের কাজের জন্য সেখানে দিনের কিছু সময় লোডশেড করা হয়। খুলনা অঞ্চলে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে সম্প্রতি বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছু সমস্যা ছিল। বর্তমানে ওই সমস্যা খুবই কম। আর বরিশাল ও নোয়াখালী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকতে পারে অল্প কিছু সময়ের জন্য, দীর্ঘ সময় নয়। আর সব জেলাতেই অনেক সময় সাবস্টেশন বা বিতরণ লাইনের শাটডাউন বা রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্যও কিছু সময় নির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। লো-ভোল্টেজের কারণে কিংবা বিতরণ লাইনে গাছের ডাল-পাতা পড়ার কারণে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে। তবে সেটি খুবই অল্প সময়ের জন্য। তাছাড়া গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে অনেক সময় তথ্য পেতে দেরি হয়। আবার লোডশেডের বা কারিগরি ত্রুটির কারণ জানা গেলেও তা অনেক সময় দ্রুততার সঙ্গে মেরামত করা যায় না।
এদিকে দেশে রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়। রাজধানীতে দুটি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির একটি ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি সাপ¬াই কোম্পানির (ডেসকো)। প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকার বেশিরভাগ স্থানে বিদ্যুৎ লাইনের উচ্চতার চেয়ে আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনের উচ্চতা বেশি। লক্ষ্য করা গেছে, ঢাকায় বারবার বা মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণ উচ্চ ভবন থেকে বিদ্যুৎ লাইনে ছুড়ে ফেলা বর্জ্য। যে কারণে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ যায়।
অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি তথ্য্নুযায়ী, গত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতের সাফল্য দেশের অন্য অনেক খাতের চেয়ে বেশি। বিগত ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ক্যাপটিভ এবং অবসরকৃত কেন্দ্রগুলোসহ ওই ক্ষমতা ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ থেকে ৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ) ২২০ কিলোওয়াট থেকে ৫১২ কিলোওয়াট বেড়েছে। চলতি বছরই দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়িত হবে বলে এ খাত সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। এমন অবস্থায় শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়; জনগণ নিরবিচ্ছিন্ন, স্থিতিশীল এবং মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা চায়।
এ প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এবং তড়িৎ প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামসুল আলম জানান, সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও অনেক সময় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। টাকা দিয়ে লো-ভোল্টেজের মানহীন বিদ্যুৎ পাচ্ছে জনগণ। লোডশেডের বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের যে কারণ বলছে বিতরণ কোম্পানি-সংস্থাগুলো তা সহজেই নিরাময়যোগ্য। তাদের দেখানো কারণগুলোর অধিকাংশই গ্রহণযোগ্য নয়। দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে কাজ করলে নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি একাধিক সভায়-আলোচনায় এ বিষয়ে আলোকপাত করে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে কোনো সমস্য নেই। তবে নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে । সেজন্য অনেকগুলো পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে।