নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) জাহাজে পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা মানছে না। বরং বিদেশি জাহাজে পণ্য করে গিয়ে লাখ লাখ ডলার ভাড়া গুনছে। সমুদ্রপথে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার ৫০ শতাংশ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজে পরিবহন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেজন্য বিএসসি ৬টি জাহাজও কিনেছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। কিন্তু ওসব জাহাজে পণ্য পরিবহন না করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), খাদ্য অধিদপ্তর প্রতিবছর আমদানি করা পণ্য বিদেশী হাজাজে পরিবহন খাতে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএসসির জাহাজে পণ্য পরিবহনের বিষয়ে আবারো আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ স্বার্থ রক্ষা আইন, ২০১৯ অনুযায়ী সরকারি তহবিলের অর্থে পরিবাহিত পণ্য বিএসসির মাধ্যমে পরিবহন নিশ্চিত করতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান আইন ও বিধিমালার আলোকে দেশি জাহাজে পণ্য পরিবহনের জন্য বিএসসির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক চুক্তি করা প্রয়োজন হলেও তা করা হচ্ছে না। তার আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ স্বার্থ রক্ষা আইন, ২০১৯ অনুযায়ী, সরকারি তহবিলের অর্থে সমুদ্রপথে পরিবাহিত পণ্য বিএসসির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছিল। ওই সভায় দেশি জাহাজে তেল পরিবহন নিশ্চিত করতে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও ওই প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়া হয়নি। ২০২১ সালের কমিটির কার্যপরিধি ছিল বিপিসির খাতে রিফাইন্ড প্রডাক্ট অয়েল আমদানি প্রক্রিয়া সমজাতীয় পদ্ধতিতে পরিবর্তন করে বিএসসির বিদ্যমান তিনটি প্রডাক্ট অয়েল ট্যাংকারের মাধ্যমে পরিবহনের বিষয়ে পর্যালোচনা করা। সমুদ্রপথে পরিবাহিত ক্রুড অয়েল, পরিশোধিত জ¦ালানি তেল এবং কয়লা পরিবহন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে বিপিসি, বিসিপিসিএল এবং বিআইএফপিসিএল বা অপরাপর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিএসসির বিদ্যমান কাজের পদ্ধতি, চুক্তিপত্র, আমদানি প্রক্রিয়া ও অবস্থা, কান্ট্রি ডিমান্ড, পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত টেকনিক্যাল ও অপারেশনাল বিষয়ে বিবেচনা নিয়ে বিদ্যমান আইন বিধির আলোকে প্রস্তাবিত জাহাজগুলোর দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের রূপরেখা প্রণয়ন করা। পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতা স্মারক সম্পাদনের লক্ষ্যে চুক্তি পদ্ধতি বা গাইডলাইন প্রণয়নের কাজ করা। কিন্তু গঠিত কমিটি ওই সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদনই জমা দেয়নি।
সূত্র জানায়, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের আমদানি পণ্য বিএসসি জাহাজে পরিবহনকালে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সাধারণ বীমা করপোরেশনের মাধ্যমে প্রিমিয়াম দেয়া হয়। সেজন্য দেশি বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু বিদেশি জাহাজ প্রতিষ্ঠানগুলো এদেশের সঙ্গে চুক্তি করেনি। ফলে দেশীয় জাহাজে পণ্য পরিবহন না করায় ইনস্যুরেন্সের টাকা অপচয় হচ্ছে। বর্তমানে বিএসসির ৬টি জাহাজের মধ্যে ৩টি অয়েল ট্যাংকার এবং ৩টি বাল্ক ক্যারিয়ার (খোলা পণ্য পরিবহন জাহাজ) রয়েছে। প্রতিটি জাহাজে ৩৯ হাজার মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা যায়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ওসব জাহাজ কেনা হয়। তারপর ২০১৯ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ স্বার্থরক্ষা আইন পাস হয়। ওই আইনে আমদানি পণ্য পরিবহনে ৫০ শতাংশ দেশি জাহাজে আনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ২টি মাদার অয়েল ট্যাংকার এবং ২টি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার বিএসসির পরিকল্পনা ছিল। ওসব জাহাজে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ পণ্য পরিবহন করা যাবে। সেজন্য চীন সরকার ঋণ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ওসব জাহাজ কেনা হয়নি। তবে দাতা সংস্থার সহযোগিতায় বা বৈদেশিক ঋণে শিগগিরই তা কেনা হবে। তাছাড়া বিএসসির আরো কয়েকটি কনটেইনার জাহাজ কেনার পরিকল্পনা আছে।
সূত্র আরো জানায়, বিপিসি, বিসিআইসি, বিএডিসি ও খাদ্য অধিদপ্তর স্বাধীনতার পর থেকেই বিদেশি জাহাজে পণ্য পরিবহন করছে। সেজন্য যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহ করছে তারাই গ্রুপিং করে বিদেশি জাহাজে পণ্য দেশে পৌঁছে দিচ্ছে। তাতে তারা আমদানি ও পণ্য সরবরাহ দুইভাবে লাভবান হচ্ছে। দীর্ঘদিন ওই প্রক্রিয়া চলতে থাকায় ওই পদ্ধতি বাদ দেয়া যাচ্ছে না। আবার বিএসসির জাহাজেরও সঙ্কট রয়েছে। আমদানিকারক সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের মতে, আমদানি করা পণ্য পরিবহন করার মতো সক্ষমতা বিএসসির নেই। তাছাড়া বিপিসি যাদের কাছ থেকে তেল আমদানি করে তারাই জাহাজ সরবরাহ করে থাকে। তাই চাইলেও তেল আমদানিতে দেশি জাহাজ ব্যবহারের সুযোগ নেই। আর সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া চাহিদা অনুযায়ী গম আমদানি করা যাচ্ছে না। দেশীয় জাহাজে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু দীর্ঘদিন বিদেশি জাহাজে চাল ও গম পরিবহন করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) শাহ মো. ইমদাদুল হক জানান, সার আমদানির সময় পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে বিএসসির সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা হয়। তবে সক্ষমতা না থাকায় তাদের জাহাজে সার আমদানি করা যায় না। তবে বিএসসি সংশ্লিষ্টদের দাবি, বিএসসির সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সামনে আরো বড় পরিকল্পনা আছে।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (সংস্থা) নজরুল ইসলাম জানান, আগের কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। সেজন্য গত বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ডলার সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার কৌশল থেকে বৈঠক আয়োজন করা হয়। বিপিসি তাদের পরিশোধিত করা পুরো তেল বিদেশি জাহাজে আমদানি করে থাকে। তা যেন বিএসসির মাধ্যমে করে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
অন্যদিকে নৌ-পরিবহন সচিব মোস্তফা কামাল জানান, বিপিসি এখন থেকে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী জাহাজে তেল পরিবহন করবে। সেজন্য বিএসসির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) চুক্তির মাধ্যমে যে তেল কেনা হবে তার বেশির ভাগ বিএসসির জাহাজে আনা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) পীযুষ দত্ত জানান, বিএসসির জাহাজে পণ্য আনলে সরকারের ডলার সাশ্রয় হতো। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত পণ্য পরিবহনে এই নিয়ম মানা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি