নিজস্ব প্রতিবেদক:
ক্রমাগত লোকসানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম)। মূলত কাঁচামাল নিয়ে পুরোপুরি বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ার কারণেই কেপিএম এমন অবস্থায় পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার নিয়ন্ত্রিত ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) পরিচালিত ওই প্রতিষ্ঠানটিকে হয় এখন বন্ধ ঘোষণা করতে হবে, তা নাহলে নতুনভাবে পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এক সময়ে কেপিএমের আয় দিয়ে বিসিআইসির অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চালানো হতো। কিন্তু এখন বিসিআইসির অনুদানে ওই কাগজ মিলটিকে কোন রকমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আমদানিনির্ভর কাঁচামালের অভাবে কর্ণফুলী পেপার মিলটি গত ঈদ-উল-আজহার পর থেকে উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এখনো তার অবসান ঘটেনি। ১৯৫১ সালে এশিয়ার বৃহত্তম ওই মিলটি যাত্রা শুরু করে এবং ১৯৫৩ সালে তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। পার্বত্যাঞ্চলে বনজ সম্পদের সহজলভ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় এনে চন্দ্রঘোনায় ওই মিলটি স্থাপন করা হয়। শুরু থেকে কেপিএম একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ওই লাভের অর্থ দিয়ে সেখানে কর্ণফুলী রেয়ন মিলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু বিগত ২০০১ সালের পর থেকে নানামুখী অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারণে কেপিএমের লোকসান শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে লোকসানের পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা। তাছাড়া অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেরই বকেয়া হয়ে আছে। ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের পাওনা রয়েছে ১শ’ কোটি টাকারও বেশি। বর্তমানে ওই মিলে স্থায়ী-অস্থায়ী ৭ শ’য়ের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৩ শ’জন স্থায়ী। বিসিআইসির তহবিল থেকে তাদের বেতন ভাতা আসছে।
সূত্র জানায়, মিল কর্তৃপক্ষদীর্ঘ ৫ বছর আগে বাঁশ, কাঠ থেকে পাল্প উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তারপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামাল আমদানিতে বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ে। আর তাতেই প্রতিষ্ঠানটি ডুবে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে আমদানি পাল্পের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। ফলে কাঁচামাল সঙ্কট তীব্র হওয়ায় গত ঈদের পর থেকে ওই মিলে কাগজ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। মাঝখানে কয়েকদিনের জন্য মিল চালু করা হলেও কাঁচামালের অভাবে কর্তৃপক্ষ মিল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। মূলত দেশীয় কাঠ, বাঁশ থেকে পাল্প উৎপাদন সহজলভ্য হলেও আমদানির পাল্পের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়ায় মিলটির এমন অবস্থা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি পাল্প উৎপাদনের যন্ত্রপাতি অকেজো হওয়ার কারণে বিদেশ থেকে পাল্প আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, কেপিএমে শুরু থেকেই কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হতো বাঁশ ও নরম কাঠ। তা থেকে পাল্প উৎপাদন করে সেখান থেকে ভাল মানের কাগজ উৎপাদন হতো। পরবর্তীতে কাঁচামাল হিসেবে যুক্ত হয় পুরনো কাগজ, সাইড কাটিং কাগজ ও পুরনো বই। ওই দুই ধরনের কাঁচামাল থেকে কাগজ উৎপাদন হতো। কিন্তু ২০১৭ সালে ওই মিলে বাঁশ এবং নরম কাঠ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই কাঁচামাল হিসেবে বিদেশী পাল্পের ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির পাল্পের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির প্রাতিষ্ঠানিক লোকসান বাড়ছে। অথচ কেপিএমের ১ লাখ ২৭ হাজার একর ভূমি রয়েছে। তার মধ্যে ১শ’ একর এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেপিএম। ৩শ’ একর এলাকাজুড়ে রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসস্থান। অবশিষ্ট জমি বনায়নের জন্য রাখা হয়েছে। যেখান থেকে বাঁশ ও নরম কাঠ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু ওসব বাঁশ ও নরম কাঠ বাদ দিয়ে পাল্পের আমদানিনির্ভরতার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনে ধস নেমেছে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ সালে কেপিএম ১৫ লাখ ৯৫ হাজার বাঁশ সংগ্রহ করেছিল। আগে যেখানে বাঁশ থেকে ১ টন কাগজ উৎপাদনে কাঁচামালের বিপরীতে ব্যয় হতো সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। সেখানে আমদানির পাল্পের জন্য টনপ্রতি খরচ আসে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।
এদিকে কেপিএমের কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুষছে। তাদের মতে, র্উর্ধতন কর্মকর্তাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই আজ মরণ দশায় কেপিএম। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একেকজন একেক রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই কারখানার পরিস্থিতি ক্রমেই পিছিয়ে গেছে। আর কিছু কর্মকর্তার অযোগ্যতার পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি