নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) রাজধানীতে চলাচলরত লক্কড়-ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। ওসব যানবাহনকে আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে ত্রুটিমুক্ত করার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। তারপর থেকে রাজধানীর ওই ধরনের গাড়ির দেখা মিলবে সেখানেই আটক করে ডাম্পিংয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কারণ নগরের সৌন্দর্য ও দেশের ভাবমূর্তি অনেকাংশে গণপরিবহনের সৌন্দর্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু রাজধানীতে রংচটা, জরাজীর্ণ, জানালা-দরজার কাচ ভাঙ্গা, সামনে-পেছনের লাইট ভাঙ্গা বাস, মিনিবাস অবাধে চলাচল করছে। তাছাড়া কিছু বাস, মিনিবাসে ভেতরে ফ্যান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ভাঙ্গা ও অচল থাকে। সিটের কভারও অপরিষ্কার। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ত্রুটিমুক্ত যানবাহন চলাচলে বাধ্যবাধকতা এবং এর ব্যত্যয়ে আইনের ধারা অনুযায়ী কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। আগামী ৩০ নবেম্বরের পর মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিআরটিএর কাছে রাজধানীতে কী পরিমাণ ত্রুটিপূর্ণ ও লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি চলাচল করছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সংস্থাটির কাছে শুধু রেজিস্ট্রেশনকৃত বাস, মিনিবাসের তথ্য রয়েছে। ঢাকা ও এর আশপাশে সাড়ে ৮ হাজার বাস-মিনিবাস চলার অনুমতি আছে। কিন্তু ওই সংখ্যা ওঠানামা করে। অনেক কোম্পানি অনুমোদনের চেয়ে বেশি বাস চালায়। রাজধানীতে চলাচল সব বাস, মিনিবাসের বেশিরভাগেরই রং উঠে গেছে। পেছনের লাইট-ইন্ডিকেটর নেই। ওসব বাস কখন থামে, কোন দিকে মোড় নেয় তা পেছনের চালকের বোঝার উপায় নেই। ডানে-বাঁয়ে বা পেছনে দেখার আয়না নেই। পেছনের ভাঙ্গা অংশে লেগে পাশের গাড়ির রং উঠে যাচ্ছে। তাছাড়া ঢাকা মহানগরে চলাচলরত বেশিরভাগ বাসই ২০ বছরের পুরনো। ওসব বাসের একটা বড় অংশ কালো ধোঁয়া নির্গমন করে। বাসের ব্রেকও থাকে ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া অবৈধ হাইড্রলিক হর্নের কারণে এবং যথাযথ রিয়ার ভিউ মিরর ও সিগন্যাল বাতির অভাবে সেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিক্সাসহ বেশিরভাগ যানবাহনেরই নেই বৈধ লাইসেন্স। যদিও সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশব্যাপী সড়কে ২০ বছরের অধিক পুরনো বাস ও মিনিবাস জাতীয় যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একইভাবে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ সমজাতীয় পণ্যবাহী যানবাহনের সর্বোচ্চ বয়স হবে ২৫ বছর। দুর্ঘটনা কমাতে এবং পরিবেশ দূষণরোধে যানবাহনের ওই আয়ুষ্কাল সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যা ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। তবে সরকার নির্ধারিত ওই আয়ুষ্কাল আন্তর্জাতিক মানদন্ডের চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণত বড় বাসের ক্ষেত্রে গড় আয়ু ধরা হয় সর্বোচ্চ ১২ বছর আর ছোট বাসের ক্ষেত্রে তা ৭ থেকে ১০ বছর। নির্মাতা কোম্পানিগুলোও বাসের গড় আয়ু সর্বোচ্চ ১২ বছরের মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা শহরে মোট নিবন্ধিত বাস, মিনিবাসের সংখ্যা ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার। তার মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বাসই রংচটা। কোনটির কাচ ভাঙ্গা, কোনটির লুকিং গ্লাস নেই, কোনটির সামনে-পেছনের বাম্পার খোলা, কোনটির জানালার কাচ অর্ধভাঙ্গা হয়ে ঝুলছে, কোন কোনটির আবার বডি দুমড়ানো-মোচড়ানো। আবার কোন কোন গাড়ি ভাঙ্গাচোরা না হলেও রাস্তায় চলাচলের সময় ঘষাঘষির কারণে দুই-তিন মাসের মধ্যেই রং উঠে কদাকার হয়ে যাচ্ছে। ওই রকম বাস রাজধানীজুড়েই চোখে পড়ে। ট্রাফিক পুলিশকে নিয়মিত টাকা দিয়ে রাজপথে চলছে ওসব গাড়ি। তবে প্রতিবছর যখন বিআরটিএর অভিযান জোরদার থাকে তখন ওসব গাড়ি ঢাকার আশপাশে পাঠানো হয়। আর অভিযান স্তিমিত হলেই সেগুলো ধীরে ধীরে রাজধানীতে প্রবেশ করে। এ নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বাস মালিকপক্ষের গোপন অলিখিত চুক্তি আছে। অভিযানের সময় ছাড়া গাড়ি ধরলে ছেড়ে দেয়া হয়। কারণ বাস মালিক ট্রাফিক পুলিশকে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয়।
সূত্র আরো জানায়, রাজধানীতে চলাচলত ব্যবহারের অনুপযোগী যানবাহনের মালিকদের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের মধ্যেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুর্নীতি। কোন গণপরিবহনকে রাস্তায় চলাচলের জন্য বিবেচিত হতে হলে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ওসব পরীক্ষা সামান্য সংখ্যক যানই উৎরে যেতে পারে। কিন্তু মালিকদের হস্তক্ষেপে গাড়িগুলোকে যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই শুধু বাইরের রং দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়া হয়। ঢাকার গণপরিবহন খাতে ব্যাপক অসঙ্গতি ও অনিয়ম দূর করা এবং ব্যবহার অযোগ্য বাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণে বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহলের বাধায় ওসব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। বর্তমানে দৈনিক রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হাজার হাজার মানুষ বাসের ওপর নির্ভর করে। রাজধানীর ১৯৩টি রুটে যাত্রী নিয়ে প্রতিদিন ৬ হাজারেরও বেশি বাস চলে। বর্তমানে রাজধানীতে ফিটনেস ছাড়া গাড়ির সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ।
এদিকে সরকার বিগত ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে ২০ বছরের পুরনো যানবাহন সরিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। তবে এখনো তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। ঘোষণা দিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে যৌথভাবে বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। অভিযান পরিচালনায় সহায়তা করেন পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার আগের অবস্থায় চলে যায়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, একটা দেশের রাজধানীতে এমন লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন চলতে পারে না। রাজধানীতে চলাচল করা বাসের মধ্যে ৮০ শতাংশেরই বয়স ২০ বছরের বেশি। রাজধানীকে ওসব গাড়িমুক্ত করতে হবে। আর আইনি কাঠামোতেই তা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, ত্রুটিপূর্ণ বাস চলাচল বন্ধে সারাবছরই বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়। বিআরটিএ পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে অভিযান শুরু করেছে। সেখানে কোন গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকলেও বডি খারাপ হলে সেটাকে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব গাড়ির ফিটনেস দেয়া হয়নি সেসব গাড়িও রাস্তায় নেমেছে। ওসব গাড়ির বিরুদ্ধে বিআরটিএর অভিযানটা এবার জোরালোভাবেই হবে। বিআরটিএ এখন যে গাড়ির ফিটনেস দেয় ওই গাড়ির একটা ছবি তুলে রাখে। একই সঙ্গে যে ইন্সপেক্টর ওই গাড়ির সার্টিফিকেট দেন তার ছবিও গাড়িতে থাকার কথা। কোন কর্মকর্তা গাড়ি না দেখেই অনুমোদন দিলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। ফলে আইন অমান্যকারীদের রেহাই নেই।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক