নিজস্ব প্রতিবেদক :
গ্যাসের সংকটে দেশে অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছর চালু হচ্ছে এলএনজিভিত্তিক ৪টি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু এলএনজিভিত্তিক ওই নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে না পারলে বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তালিকা আরো দীর্ঘ হবে। জ্বালানির নিশ্চয়তা বিবেচনায় না নিয়েই এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনুমোদন দেয়ায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের প্রয়োজন। কিন্তু তার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ১ হাজার ২০০ এমএমসিএফডি। ৩০০ এমএমসিএফডি ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর আগামী ৫-৬ বছরে গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র আসছে সেগুলোর হিসাব করলে শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে দুই হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের চাহিদা তৈরি হবে। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগামী বছর উৎপাদনে আসছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর (এলএনজি) ৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মোট ২ হাজার ৩৩৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার ওই কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৩টি বেসরকারি পর্যায়ে এবং একটি সরকারিভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে ওসব এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি হিসেবে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিতে ইতিমধ্যে ৩টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। এলএনজিভিত্তিক বেসরকারি তিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা মোট ১ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট। আর সরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সক্ষমতা হবে ৪৫০ মেগাওয়াট। ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে গেলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে।
সূত্র জানায়, এলএনজিভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে গেলে দৈনিক আরো ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে। ফলে ওসব কেন্দ্র চালু করতে হলে গ্যাস সংকট মেটানো না গেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখতে হবে। পেট্রোবাংলা ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে চিন্তিত। তবে দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা পূরণে গত দু’মাসে ৩টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। গত ১৬ জুন ভারতের সঙ্গে এলএনজি আমদানি করতে এইচ-এনার্জির সঙ্গে পেট্রোবাংলা চুক্তি করে। ওই চুক্তি মোতাবেক এলএনজি আমদানিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এলএনজি টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। আর ওই পাইপলাইনের মাধ্যমেই ভারত থেকে বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া এলএনজি আমদানি করতে গত ১৩ জুলাই মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে বাংলাদেশ। দেশটির পেট্রোনাস এলএনজি লিমিটেড ও গ্লোবাল এলএনজি এসডিএন বিএইচডি এবং পেট্রোবাংলার মধ্যে ওই সমঝোতা চুক্তি হয়। তবে ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় এবং কী পরিমাণ এলএনজি ওই দেশ থেকে আমদানি করা হবে তা জানানো হয়নি। আর সম্প্রতি বাংলাদেশসহ এশীয় অঞ্চলে এলএনজি সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি কমনওয়েলথ এলএনজির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সই করেছে সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি। বছরে ১০ লাখ টন এলএনজি আমদানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ওই সমঝোতা চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে ওই চুক্তি হয়।
সূত্র আরো জানায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। দেশীয় গ্যাস ফুরিয়ে আসার বিপরীতে বড় ধরনের কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হওয়ায় আমদানিনির্ভর জ্বালানিতে মনোযোগী হচ্ছে সরকার। দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের সঙ্গে ৮০০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবুও প্রতিনিয়ত এক হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। ফলে ক্রমাগত বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে গ্যাস সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
এদিকে গ্যাস সঙ্কট বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান না থাকায় আমদানি ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প নেই। দেশে যে হারে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের যে চাহিদা বেড়েই চলেছে, তাতে সহজ হিসাব হলো আমদানি করা। তবে আমদানিতে অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে পড়লে দেশের জ্বালানি খাত বিপাকে পড়বে। পাশাপাশি বিশাল সম্পদ বছরের পর বছর অনাবিষ্কৃতই থেকে যাবে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জানান, আগামীতে গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে, সেখানে প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন হবে। ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে সরকার এলএনজি আমদানি করছে। দেশে বর্তমানে গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে, সেখানে ৬০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রেই ৩০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। ওই ঘাটতি মেটাতে হলে এলএনজি আমদানি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিসুর রহমান জানান, আগামী ২০২২-’২৩ সালে গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাবে, সেগুলোর জ্বালানি নিশ্চিত করতে মূলত এলএনজি সমঝোতা চুক্তি করা হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তার বাইরে পায়রা ও মোংলায় এলএনজিভিত্তিক টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। প্রাথমিক কার্যক্রম চালিয়ে দেখা হচ্ছে ওসব জায়গায় এলএনজি টার্মিনাল করা যায় কিনা। আর তা করা গেলে দেশে সব প্রান্তে গ্যাসের সংকট কাটানো যাবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি