নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় দেশজুড়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দিনে ও রাতে দফায় দফায় লোডশেডিং হচ্ছে। কবে দূর হবে লোডশেডিং সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদার বিপরীতে কম বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে, তাই বাধ্য হয়ে ঘন ঘন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্যাস না পাওয়ায় দেশের বেশ কিছু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাধ্য হয়ে বন্ধ রাখতে হয়েছে। এতে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। ফলে সারা দেশে বেড়ে গেছে লোডশেডিং। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক গ্যাসের চাহিদা তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গড়ে সরবরাহ করা হতো তিন হাজার থেকে তিন হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু কিছুদিন থেকে গ্যাসের সরবরাহ ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট কমেছে। এদিকে গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে শিল্পকারখানাগুলোতে। দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ থাকলেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বন্ধ রাখতে হয় কারখানা। আর রাতে বিদ্যুৎ ফিরলেও, নেমে যায় গ্যাস প্রবাহের চাপ। এই পরিস্থিতি চলছে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে ক্যাপটিভ পাওয়ার, বয়লার ও ওয়াশিং প্ল্যান্টের জন্য দরকার হয় গ্যাস। বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুতের দ্বৈত সংকটে পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতেই হিমশিম খাচ্ছে পোশাক কারখানাগুলি। এই সংকট কতদিন চলবে সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই তাদের। এই পরিস্থিতিতে স্পট মার্কেট থেকে প্রতিমাসে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য ২০০ কোটি ডলার চেয়েছে খাতটি। এদিকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়েছে ইস্পাত কারখানাগুলো। চট্টগ্রাম-ভিত্তিক জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় প্রতিদিন রড উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন। গত দেড় মাস ধরে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ক্রমাগত কমতে থাকে। বর্তমানে জিপিএইচ এর কারাখানায় প্রতিদিন গড়ে ১,৫০০- ২,০০০ হাজার টন রড উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন ও বিক্রিতে ধস নামায় বর্তমানে প্রতিমাসে টনপ্রতি ১ থেকে দেড় হাজার টাকা লোকসান দিয়ে রড বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। কারণ উৎপাদন কমে গেলেও প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কর্মীর বেতন ও মজুরিও পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে জানান এক কর্মকর্তা। জিপিএইচ ইস্পাতের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্যাস সংকটে ফলে পাওয়ার প্ল্যান্ট অর্ধেকও চালাতে পারছি না। অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখতে হয়। গত ১ মাস যাবত পাওয়ার প্ল্যান্টের ৩টি ইঞ্জিনের মধ্যে ২টি ইঞ্জিন কখনো একসাথে চালাতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে আমরা বিপুল আর্থিক লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছি। অন্যদিকে ইউরিয়া সার কারখানাগুলি পুরোপুরি গ্যাস প্রাপ্তির ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস সরবরাহের অভাবে গত জুন থেকেই বন্ধ আছে যমুনা সার কারখানা। গত জুলাই মাসে গ্যাস সংকটে বন্ধ হওয়া অন্যদুটি কারখানা এক মাসের মধ্যেই সচল হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামে গ্যাসের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকা দুটি কারখানা- কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড। রক্ষণাবেক্ষণে থাকায় আপাতত কারখানা দুটিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এই দুটি কারখানায় দৈনিক চাহিদা ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। উভয় কারখানা উৎপাদনে ফিরলে সেখানে গ্যাস সংকট পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে সিরামিক শিল্পে উৎপাদন ইউনিটগুলি সচল রাখতে ৫০০ থেকে ১৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উৎপন্ন করে সিরামিক টাইলস বা ব্রিক তৈরির ক্লে পোড়াতে হয়। এর চেয়ে ভালো পরিস্থিতি নয়- গ্যাস-নির্ভর স্টিল রিরোলিং মিলসের মতো শিল্পেও। তাদের চুল্লিগুলিতে ৯০০- ২,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হলেও, গ্যাসের প্রেসার পাচ্ছে দরকারের চেয়ে ২৫-৫০ শতাংশ কম। শিল্পটি উৎপাদন অর্ধেকে নামালেও- শ্রমিকদের মজুরিসহ অন্যান্য খরচের ভার ঠিকই ওঠাতে হচ্ছে। জানা গেছে, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলি থেকে সরবরাহ যখন গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন এলএনজি আমদানির মাধ্যমে সে ঘাটতি পূরণ শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু, করোনার কারণে সরবরাহ সংকটে বৈশ্বিক এলএনজি মূল্য বহুগুণে বেড়ে যায়, পরিস্থিতির আরও অবনতি করে ইউক্রেনে যুদ্ধ। আমদানি ব্যয় কমাতে সরকার খোলা বাজার (স্পট মার্কেট) থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখায় গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় গ্যাস সরবরাহ কমেছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মিটার ঘনফুট (এমএমসিএফ)। সরকারের নেওয়া এ সিদ্ধান্তে দেশব্যাপী অসহনীয় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। লোডশেডিং এর বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে জ¦ালানির বাজারে। যে এলএনজি আগে পাঁচ ডলারে পাওয়া যেত, এখন সেটির দাম ৩৫ থেকে ৪০ ডলার। জার্মানি, ইতালির মতো উন্নত রাষ্ট্রও এখন লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছে।
গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। তিনি বলেন, শীত না আসা পর্যন্ত অক্টোবরেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। কারণ, চলমান ডলার সংকটের কারণে (স্পট মার্কেট থেকে) গ্যাস আমদানিও করা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি