নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিগত বছরে সবচেয়ে বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি’। এই সময় দুই বছরের কন্যাশিশু থেকে শুরু করে ৭৫ বছর বয়সী ৮১০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে ওই কমিটি। ‘নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধ করি, নতুন সমাজ নির্মাণ করি’ স্লোগানকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় কনভেনশন সোমবার (২৮ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারর্স ইনস্টিটিউটে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের প্রাচীন আইনের কথা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, ১৮৬০ সালের একটি আইনে বলা হয়েছে ১৩ বছরে ঊর্ধ্বে বয়সী শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলে আইনে এর প্রতিকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই আইনগুলোতে পিতৃতান্ত্রিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আইনের পাশাপাশি ধর্ষণের শিকার নারীরা তখনও তাদের বঞ্চনার শিকার হয়। তারা ন্যায়বিচার পান না। নারী ও শিশু দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালেরও কোনো স্বচ্ছতা নেই। সেখানেও তারা নিগ্রহের শিকার হন। জাতীয় কনভেনশনে ২০২১ সালে প্রাকাশিত মহিলা পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি দুই বছরের শিশু থেকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত। জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্ট এর মতে, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, এই সময়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৮১০টি। আর এই সময়ে সংবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২২৫টি, এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টা হয় ১৯২টি। অন্যদিকে উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ৯৬টি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ২০২১ সালের নারী ও কন্যা নির্যাতনের এ ঘটনার তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি এবং তরুণরা ধর্ষণের মতো অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে জড়িত হচ্ছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২২ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ২০৫টি সংবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৭টি, কিন্তু ২০২২ সালে জানুয়ারি-আগস্ট এই ৮ মাসের মধ্যেই ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৭টি। ২০২১ সালে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে আর ২০২২ সালে অক্টোবর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে। এসব ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করা নারী ও কন্যারা ভার্চ্যুয়ালি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিভিন্ন গবেষণা সূত্রমতে করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশের নারী ও কন্যারা বিভিন্ন কারণে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে দ্বিগুণ হারে। বাল্যবিয়ের হার বেড়ে যাওয়া এসব কারণের মধ্যে একটি। পাশাপাশি বেড়েছে সব ধরনের সহিংসতা। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্যমতে, দেশে করোনা মহামারির দুই বছরে বাল্যবিয়ে বেড়েছে ১০ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ জেন্ডার স্ট্যাটিকটিস অব বাংলাদেশ ২০১৮ জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের ১৬১টি দেশ ও অঞ্চলে নারী নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন (২০০০-২০১৮) অনুসারে, বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। নারী নির্যাতনের এসব চিত্র নারী আন্দোলন এবং নাগরিক সমাজকে গভীর উদ্বিগ্নতার বার্তা দিচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. কাবেরী গায়েন। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ব্যারিস্টার রাশেদুল হক অমিত। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম। জাতীয় কনভেনশনে ৪২টি জেলা থেকে অতিথিরা অংশ নেন।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম