জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
দেশে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছে। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে তাদের পোহাতে হয় পাহাড়সহ প্রতিবন্ধকতা। তবুও তারা দমে যায়নি। ঠিক তেমনই একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী হলো মৌলভীবাজারের হরিবল বোনার্জি (১৭)। সে জন্ম থেকেই অন্ধ ও এক চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়তে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সে প্রতিনিয়ত। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে জিপিএ ৫ পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে সে। কারণ, নিজের মনোবলের পাশাপাশি হরিবলকে পাশে থেকে সহায়তা করেছেন তার শিক্ষকরাও।
হরিবলের বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও ইউনিয়নের হুগলিছড়া চা বাগানে। সে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। মা বিশখা বোনাজি ও বাবা অনিল বোনার্জি দুজনের চা বাগানের শ্রমিক। অভাব আর অনটনের সংসারে হরিবলের পড়ালেখা শুরু হয়েছিলো এনজিও ব্র্যাক স্কুল থেকে। সেখান থেকে ভাল ফলাফলে পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের পাশেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন মৌলভীবাজার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের ছাত্রাবাসের আবাসিক হোষ্টেলে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যায় সে।
শারিরীক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি সামাজিক অবস্থানের কারণে শুরু থেকেই নানা বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু অন্ধত্ব কিংবা সামাজিক অবস্থান কোনোকিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বরং অন্ধত্বকে জয় করে হরিবল এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করেছে।
২৯ নভেম্বর বিকেলে কথা হয় হরিবল বোনার্জির সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, পড়ালেখা করে এতদূর এগিয়ে আসতে পারবো সেটা কখনো কল্পনা করিনি। তবে আমার পড়াশোনায় প্রবল আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় আমি যখন পিএসসি পরীক্ষা দেই তখন সেই পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। পরে ভর্তি হই মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে সমাজসেবা অফিসের সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের ছাত্রাবাসে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি পড়ালেখার পাশাপাশি আমাদের পিছিয়ে পরা চা শ্রমিকদের বিনামূল্যে টিউশনিও পড়িয়েছি। করোনাকালীন সময়ে যখন স্কুল বন্ধ ছিল তখন আমার গ্রামের শিক্ষার্থীদের একসাথে নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেছি।
তিনি আরো বলেন, পড়ালেখার জন্য আসলে দিনে একটানা দশ ঘন্টা পড়তে হয় না। মনযোগ দিয়ে কয়েকঘন্টা পড়লেই হয়। পরীক্ষার হলে অন্যান্য সাধারণ ছাত্রদের সাথে আমি পরীক্ষা দিয়েছি। শুধুমাত্র আমার সহযোগী হিসেবে অষ্টম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। আমি বলে দিয়েছি আর সে লিখে দিয়েছে। আমার স্বপ্ন ছিল একজন গায়ক হওয়ার, অনেকটা পথও এগিয়েছিলাম। কিন্তু আর গায়ক হয়ে উঠা হয়নি। এখন একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষক হতে চাই।
হরিবল বোনার্জি তার এই সফলতার জন্য সকল শিক্ষক, মা-বাবা, সমাজসেবা অফিসের রিসোর্স শিক্ষক, স্কুলের শিক্ষকগণ ও পরীক্ষা কেন্দ্রের সহযোগীকে উৎসর্গ করতে চান। ভবিষ্যৎ জীবনে সফল হওয়ার জন্য সে সকলের কাছে আশির্বাদ চায়।
মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আ. খ. ম ফারুক আহমদ বলেন, হরিবল আমাদের স্কুলের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। সে তার অদম্য প্রচেষ্ঠায় এবারের এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় অনেক কষ্টের বিনিময়ে পড়ালেখা করে সে এই সাফল্যে অর্জন করেছে। আশাকরি সে তার জীবনের অভিষ্ট্য লক্ষ্যে পৌঁছাবে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি