নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা মহামারির সময় সারা দেশে বন্ধ থাকা ১০৫টি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন এখনও চালু হয়নি। রেলে এসব ট্রেন ‘গরিবের’ বাহন হিসেবে পরিচিত। প্রচ- চাহিদা থাকার পরও লোকাল ট্রেন চালুর কোনো উদ্যোগ নেই। কবে নাগাদ চালু হবে, তারও কোনো উত্তর নেই। বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭৫ ভাগ যাত্রীই বহন করে লোকাল ট্রেন। অথচ রেল কর্তৃপক্ষের বেশিরভাগ মনঃসংযোগই যেন দূরপাল্লার ট্রেনকে ঘিরে। লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার নেপথ্য কারণ হিসেবে অনেকে আবার বাস মালিকদের সঙ্গে রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগও করছেন। তবে এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি। তারা বলছেন, এসবই ভিত্তিহীন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনের সময়সূচী অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে মোট ৩৬৮টি ট্রেন চলাচল করছে, কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা ২৬৩টি এবং বাকি ১০৫টি ট্রেন বন্ধ রয়েছে। ১০৫টি ট্রেনের মধ্যে ৫৪টি পূর্বাঞ্চলে – ৩৪টি লোকাল, ৬টি মেইল এবং ১৬টি কমিউটার ট্রেন। অন্য ৫১টি ট্রেন পশ্চিমাঞ্চলে – ৩৯টি লোকাল, ৪টি মেইল এবং ৮টি কমিউটার ট্রেন। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইঞ্জিন, কোচ ও জনবল সংকটের কারণে লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হচ্ছে।
রেলওয়ের সূত্র বলছে, গত আড়াই বছর ধরে ময়মনসিংহ থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা, সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের চাতক উপজেলা, ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী, লাকসাম-চাঁদপুর-লাকসাম, লাকসাম-নোয়াখালী-লাকসাম, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-এসহ রুটে মোট ১০৫টি ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। রুট। হালকা পণ্য পরিবহনের জন্যও এসব ট্রেন ব্যবহার করতেন ব্যবসায়ীরা।
কথা হয় এসব রুটে চলাচলকারী কিশোরগঞ্জের ভৈরবের বাসিন্দা স্বপন আহম্মদের সঙ্গে। ব্যবসা জন্য তাকে প্রতিদিন ট্রেনে ময়মনসিংহে যাতায়াত করত হয়।
স্বপন বলেন, “ট্রেনে যাতায়াত সহজ। এতে সময় কম লাগে। এখন আমাকে ময়মনসিংহে যেতে প্রতিদিন অনেক কষ্ট করতে হয়।”
রেলওয়ে প্রকৌশল ও মেকানিক্যাল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও প্রায় এক যুগ ধরে রেলে নতুন ইঞ্জিনসহ অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী কোচ ক্রয় করা হলেও; লোকাল, মেইল কিংবা কমিউটার ট্রেনে নতুন কোনো কিছু সংযোজন হয়নি। অথচ রেলের হিসাবেই প্রতিবছর ট্রেনে ভ্রমণকারী প্রায় ১০ কোটি যাত্রীর ৭৫ ভাগই বহন করে লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন। এর ফলে রেলের আয়ও কমে গেছে। দুর্ভোগ বেড়েছে অল্প আয়ের ও দূরত্বে চলাচলকারী রেলযাত্রীদের।
সূত্র মতে, গত ১২ বছরে রেলওয়ের উন্নয়নে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে রেললাইন, সেতু, ভবন নির্মাণ এবং ইঞ্জিন ও কোচ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। তারপরও রেল খাতে সরকার লোকসান করছে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এই ক্ষতির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রায় সকল আন্তঃনগর, লোকাল ও কমিউটার ট্রেনের কোচ ও ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে আগেই। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ইঞ্জিন ও কোচ দিয়েই ট্রেনগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব ট্রেন উনিশ-বিশ হলেই লাইনচ্যুতসহ চলন্ত অবস্থায় বিকল হয়ে পড়ছে। জানা গেছে, বন্ধ রাখা ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন কোচগুলোকে পাহাড়তলী ও সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পাঠানো হয় মেরামতের জন্য। তবে আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া লোকাল ও মেইল ট্রেনগুলো বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ ছিল আগে থেকেই।
তবে, ৬৭% ইঞ্জিন এবং ৪৭% কোচ চালু আছে যদিও তাদেরও জীবনকাল শেষ। গত এক দশকে ইন্দোনেশিয়া থেকে কেনা ৩৫০টি কোচের বিভিন্ন কাপলিং পদ্ধতি রয়েছে তাই একটি ভেঙে গেলে অন্যটি ব্যবহার করা যাবে না। সংকটের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ৩০টি ইঞ্জিন সব রুটে চলাচলের উপযোগী নয়। এরপর ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে আনা ২০ সেট ডিইএমইউর অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়েছে।
রেলওয়ের সূত্রে জানা যায়, ট্রেন বন্ধ থাকার পাশাপাশি জনবলের ঘাটতির কারণে সারাদেশে মোট ১১৫টি স্টেশন এখন বন্ধ, চালু আছে ৩৬৯টি স্টেশন। এছাড়া, রেলওয়েতে মোট ৫৮৪১টি অফিসিয়াল পদের মধ্যে মাত্র ২৩৯৫টি পদ ম্যানেজড এবং বাকি ৩৪৪৯টি পদ শূন্য রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ১ হাজার ৬৪০টি পদের বিপরীতে ৫৯৪ জন স্থায়ী ও ৭২ জন চুক্তিভিত্তিক স্টেশন মাস্টার নিয়োগ করা হয়েছে এবং বাকি ১০৪৬টি পদ শূন্য রয়েছে। একইভাবে, ৫৩৪টি গার্ড পদের মধ্যে ২০১টি পদ শূন্য এবং ১৬৮৬টি পয়েন্টম্যান পদের মধ্যে ৯০৮টি শূন্য রয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ