নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর :
চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ সাত হাজার হেক্টর জমিতে। রংপুর জেলায় চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ১লাখ ৩১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সাড়ে সাত হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে।
রংপুর মহানগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বালাকুমর এলাকার কৃষক হান্নান মিয়া (৫০) বলেন, “বাহে হামারা কৃষক মানুষ, হামরা কেমন করে আবাদ করবো, দ্যাখ্যান না সব কিছুর দাম বেড়েছে। এত দাম বাড়ছে বাহে, যা বলার শেষ নাই। “সার, বীজ, কীটনাশক কোনোটাই এখন আর আগের দামে মিলছে না। কৃষকরা এত টাকা কেমন করে যোগান দেবে বাহে, তোমরা কনতো। হামার মরণ দশা কৃষকদের।”
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, দেশের মানুষের চালের ৬০ ভাগ জোগান আসে বোরো মৌসুম থেকে। আর এই চালের জোগানের প্রায় অর্ধেকের বেশি যায় উত্তরাঞ্চল থেকে। কৃষকরা বলছেন, গত বছরের মাঝামাঝিতে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি আর এ বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে চলতি মৌসুমে বোরো উৎপাদনে খরচ বাড়ছে কৃষকের। এ ছাড়া সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় প্রতি বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনে বাড়তি খরচ হবে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা। তারা জানান, গত বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে সেচের খরচ ছিল এক হাজার ২০০ টাকা, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬০০ টাকায়। বীজ প্রতি কেজি ছিল ২০০ টাকা, এবার তা হয়েছে ৩৫০ টাকা। এ ছাড়া জমি তৈরি ৯০০ থেকে ১৩০০ টাকা, সার খরচ দুই হাজার থেকে বেড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা, কীটনাশক ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা, ধান রোপণ এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা, ধান কাটা-মাড়াই তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা হয়েছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হবে জমির ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা।সে হিসেবে গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়ছে চার হাজার ৫৫০ টাকা। রংপুর মহানগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জওড়ার হাট এলাকার কৃষক মিজানুর রহমান মিজান (৪০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বোরো ধান আবাদে জমি তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছি। তবে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবার সেচ খরচে বাড়তি টাকা গুণতে হবে আমাদের। সেই খরচ নিয়ে শঙ্কায় আছি।” এই কৃষক আরও বলেন, “এ ছাড়া শীতকালে শ্রমিক সংকটও রয়েছে। যদি শ্রমিক পাওয়া যায়, তবে মজুরি বেশি।”
মিঠাপুকুর উপজেলার ধাপের হাট এলাকার মনোয়ারুল ইসলাম মনা বলেন, “হামার সংসার কৃষির উপর নির্ভর। হামার তো আর কোন কর্ম নাই, যে হামারা তাই করি খাবো। গতবার একদোন (২২ শতাংশ) জমি বোরো আবাদে যে খরচ হয়েছে সেই জমি আবাদ করতে ডাবল টাকা লাগবে, এত টাকা যোগান দেওয়া কি সম্ভব, কন তো? “
পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের নাগদাহ এলাকার কৃষক সাদেকুল ইসলাম (৪৫) বলেন, “হামার নিজের জমিজমা নাই। মাইনষের জমি ৩০০ টাকায় লিচ আদি নিয়্যা আবাদ করি। আগের মত আর তো গরুর হাল নাই যে গরুর হাল দিয়ে চাষবাস করে নিবো। এখন তো পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর দিয়্যা চাষ করি নিতে হয়। এ্যালা তো সোগেরে দাম বেশি। “সার, বীজ ও পানি খরচ বাড়ছে। ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দাম যেভাবে হু হু করি বাড়েছে তাতে হামার মতো গরিব মাইনষোক চাষাবাদ ছাড়ি দেওয়া নাগবে।”
গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টার ইউনিয়ানের ছালাপাক এলাকার কৃষক আমিনুর রহমান বলেন, “আমাদের অব¯’া যেন- মরার উপর খাঁড়ার ঘা। সরকারের উচিত ছিল কৃষি এবং কৃষকের কথা চিন্তা করে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা। কিš‘ কেউ তো তা করছে না। “এখন ডিজেল-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষকের ওপর দিয়েই ধকল যা”েছ। এভাবেই যদি প্রতি বছর বোরো মৌসুমে উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে, তাহলে চাষাবাদ ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে হবে।” এদিকে শীত মৌসুমে যখন চাষাবাদে ব্যস্ত কৃষক, তখন নিরব”িছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহও ব্যাহত হ”েছ রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে। গেল কয়েক দিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং অব্যাহত থাকায় বাড়ছে অভিযোগ।
হঠাৎ কেন এমন বিদ্যুৎ বিপর্যয়- এ প্রশ্নের জবাবও নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মিলছে না। তবে নেসকোর এক কর্মচারী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হ”েছ। কয়েক দিনের মধ্যেই পরি¯ি’তি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর সেচ পাম্প ৬২ হাজার ৭৫৩টি, অগভীর ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৪টি, ডিজেলচালিত গভীর ৩৩২টি এবং অগভীর সেচ পাম্প রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজার ১৮টি। বোরো ধান সেচনির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় সেচে। শুধু সেচেই কৃষকের ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওবায়দুল মন্ডল বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর জেলায় চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ১ লাখ হয়েছে ৩১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সাড়ে সাত হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে।
তিনি আরও বলেন, ইরি-বোরো চাষে সহায়তায় জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দি”েছ সরকার। এবারের মৌসুমে এর মধ্যেই জেলার এক লক্ষ পাঁচ হাজার কৃষককে প্রনোদণার সার-বীজ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি হিসেবে ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসেবে দ্বায়িত্বে থাকা কমিটির মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের হাতে এই প্রণোদনা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ সাত হাজার হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমিতে।
তিনি আরও বলেন, “বোরো চাষে অতিরিক্ত সেচ লাগে। সেচ দিতে যেন পানির অপচয় না হয় সেজন্য কৃষকদের লক্ষ্য রাখতে বলা হ”েছ। সেই সঙ্গে আমাদের সুষম সারের ব্যবহারে উৎপাদন যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্যও কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হ”েছ। খরচ কমাতে কৃষকদের পরিমিত সেচ এবং নিয়ম মেনে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হ”েছ।
জাতীয় কৃষক সমিতি রংপুরের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে প্রান্তিক, বর্গা আর গরিব কৃষকরাই প্রধান। তাদের হাতে কিš‘ টাকা-পয়সা নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের উচিত সরাসরি মাঠে গিয়ে তাদের একটি তালিকা করে বিশেষ প্রণোদনার ব্যব¯’া করা। কৃষকরা যেন সেই প্রণোদনা পান, তা নিশ্চিত সম্ভব হলে উৎপাদনের ধারাটা সচল রাখা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য এই কৃষক নেতার।##
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি