নিজস্ব প্রতিবেদক:
সঞ্চালন লাইনে বিপুল বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। সঞ্চালন লাইন নির্মাণে সংস্থাটি বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় সোয়া ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তার মধ্যে বিদেশী ও স্থানীয় উৎস থেকে ঋণের ভিত্তিতে বড় একটি অংশের অর্থায়ন হয়েছে। আর সঞ্চালন নির্মাণ শেষে গ্যাস সরবরাহ না হলে জিটিসিএল আর্থিকভাবে আরো বড় ঝুঁকিতে পড়বে। এমনকি সংস্থাটি ঋণ পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি জিটিসিএলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধান হয়। জিটিসিএল গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে তা বিতরণকারী কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করে। আর সংস্থাটির আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে ওই সঞ্চালন বাবদ পাওয়া চার্জ। বর্তমানে স্থানীয় উৎস থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নেই। পাশাপাশ এলএনজি আমদানিও কমে গেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় গ্যাসের সংস্থান না হলেও ইতোমধ্যে জিটিসিএল সঞ্চালনের জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এমনকি সঞ্চালন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সংস্থাটি এরইমধ্যে আর্থিক লোকসানে পড়েছে। সূত্র জানায়, গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণে সদ্য সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্পে জিটিসিএলের মোট বিনিয়োগ ৭ হাজার ২০৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর স্থানীয় ও বিদেশী ঋণের মাধ্যমে তার বেশির ভাগের সংস্থান হয়েছে। সংস্থাটির গ্যাস সঞ্চালন বাবদ আয় থেকেই ওসব ঋণের বেশির ভাগ পরিশোধ হবে। তবে দেশের জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং সঞ্চালন চার্জের আয়ের আকার বিবেচনায় প্রকল্পে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ফলে ইতোমধ্যে আর্থিকভাবে লোকসানের মুখে পড়েছে জিটিসিএল। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিটিসিএলের কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে ২১৭ কোটি টাকা। অথচ সংস্থাটি অতীতে মুনাফায় ছিল। মূলত গ্যাস সংকটসহ অর্থনীতির নানামুখী বিপত্তির কারণেই সংস্থাটির আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। আর সামনের দিনগুলোয় সঞ্চালন বাড়ানোর মতো পর্যাপ্ত গ্যাসের সংস্থান করা না গেলে জিটিসিএলের লোকসান ও দায়ের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে জিটিসিএল ২২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ওসব প্রকল্পে বৈদেশিক ও স্থানীয় ঋণ এবং কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নসহ মোট বিনিয়োগ ৩ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে ১৫০ কিলোমিটার বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর সঞ্চালন লাইন প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৭৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এক হাজার পিএসআই ক্ষমতাসম্পন্ন ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইনটি নির্মাণে সরকারি অর্থায়ন ১ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। আর জিটিসিএলের নিজস্ব বিনিয়োগ ১০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট, হরিপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও আড়াইহাজার এলাকায় বিদ্যুৎ হাব, শিল্প ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে সরকার। আর ওসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহের জন্য কুমিল্লার বাখরাবাদ থেকে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট হয়ে হরিপুর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন করছে জিটিসিএল। ১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পে জিটিসিএলের নিজস্ব অর্থায়ন ৭৯২ কোটি টাকা এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ চুক্তির ভিত্তিতে বাকি অর্থায়ন হচ্ছে। ২০২১ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। মূলত প্রকল্পটি সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গ্যাস সরবরাহের জন্যই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে শেষ পর্যায়ে ওসব এলাকায় গ্যাসভিত্তিক প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ। আর দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর পূর্ব থেকে পশ্চিম পাড় পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ হচ্ছে। ২৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্পও জিটিসিএল বাস্তবায়ন করছে। আগামী ২০২৫ সালের জুন নাগাদ কাজটি শেষ হওয়ার কথা। তাছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের সুষ্ঠু পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে ৬৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে গ্যাস স্টেশন ও মডিফিকেশন প্রকল্পও জিটিসিএল বাস্তবায়ন করছে জিটিসিএল। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রকল্পগুলোয় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে জিটিসিএলের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
এদিকে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয় গ্যাসের চাহিদাই মেটানো যাচ্ছে না। তার মধ্যে সঞ্চালন খাতে বিনিয়োগে বিপুল পরিমাণ ঋণের আর্থিক সুফল না পেলে জ¦ালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা কিংবা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তার আগে বাস্তবায়ন হওয়া বেশ কয়েকটি সঞ্চালন লাইনে এখন পর্যন্ত গ্যাস দেয়া যায়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিটিসিএল সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে। তার মধ্যে চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন সমান্তরাল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। ওই প্রকল্পে সরকারি অর্থায়ন ১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ঋণ দিয়েছে ৭৩৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য মহেশখালীর টার্মিনালের মাধ্যমে আমদানীকৃত এলএনজি দিয়ে চট্টগ্রামের চাহিদা পূরণ করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা। যদিও স্পট মার্কেট থেকে কেনা বন্ধ থাকায় দেশে এখন এলএনজি সরবরাহ অনেকটাই কমে এসেছে। এমন অবস্থায় সঞ্চালন লাইনটি নির্মাণ শেষ হলেও সেখানে গ্যাস সরবরাহ কীভাবে চালু থাকবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত নয়। তাছাড়া দেশে গ্যাস সঞ্চালন গ্রিডে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ধনুয়া-এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়-নকলায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মোট ৮২৩ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জাইকা) ৪২৪ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে আর সরকারি অর্থায়ন ৩৯৭ কোটি টাকা। তাছাড়া পদ্মা সেতু গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ২৫৩ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে জিটিসিএল। ইতোমধ্যে লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। তবে কবে নাগাদ সেটি চালু হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। অন্যদিকে জিটিসিএলের বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সংস্থাটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কম সঞ্চালন চার্জ, প্রকল্পে বিনিয়োগ, গ্যাস সংকটে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জ¦ালানি সরবরাহ না হওয়া এবং টাকার অবমূল্যায়ন সৃষ্ট আর্থিক ঘাটতির কারণে জিটিসিএল আর্থিকভাবে লোকসানে পড়েছে। গ্যাস সঞ্চালন ও এর চার্জ বাড়ানো না গেলে সামনের দিনগুলোয় এ পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ