September 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, June 4th, 2023, 8:04 pm

কোটি মানুষের প্রিয় ফজলু মাঝির ‘দেওরা’

অনলাইন ডেস্ক :

“লেটস টক অ্যাবাউট ইট” নামে জার্মানি থেকে একটি ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করেন হাম্মাদ ও হ্যারিস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গান নিয়ে তারা পর্যালোচনামূলক ভিডিও প্রকাশ করেন। সেখানে উঠে এসেছে কোক স্টুডিও বাংলার মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা “দেওরা” গানটিও। অন্তর্জালে গানটি নিয়ে কথা বলছেন জার্মানি, সুইডেনে, ফিলিপাইন্স, তুরস্ক, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কনটেন্ট নির্মাতারাও। পশ্চিমা ঘরানার সংগীতায়োজনে গানটির সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছেন দেশ-বিদেশের অজ¯্র শ্রোতা। তেমনই একজন দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় টিকটকার কিজেমিন। আবার সুদূর তানজানিয়ার জনপ্রিয় কনটেন্ট নির্মাতা ভাই-বোনের এরকমই একটি ভিডিও ১২ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে। ইসলাম উদ্দিন পালাকার ও ফজলু মাঝির সঙ্গে দেওরার সংযোজিত অংশটি গেয়েছেন প্রীতম হাসান। “ছায়া কণ্ঠে” ছিলেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পাওয়া “শুরুয়াত” অ্যালবামে কাজ করা প্রথম বাংলাদেশি কম্পোজার আরমীন মুসা ও তার “ঘাসফড়িং কয়্যার”।

প্রীতম হাসানের কম্পোজ ও সংগীত পরিচালনায় গানটি পেয়েছে নতুন মাত্রা। কালজয়ী বাংলাকে নতুন সংগীতায়োজনে অনেকটা নতুন আদলে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে গত কয়েক বছর ধরে। “সিলোন গান লাউঞ্জ”, “আইপিডিসি আমাদের গান”, “গান বাংলা- উইন্ড অব চেঞ্জ”, আর সর্বশেষ “কোক স্টুডিও বাংলা” তেমনই উদ্যোগ। ইউটিউবে মুক্তিপ্রাপ্ত গানগুলো নিয়ে চলছে আলোচনা ও বিতর্ক। দেওরা নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। যেমন, কারও কারও প্রশ্ন ছিল, পালাকার কেন মেয়েলি পোশাক পরেছেন? রীতি অনুযায়ী, পালাকাররা নারী ও পুরুষ উভয় চরিত্রেই অভিনয় করেন। অতীতে অভিনয়ের জন্য নারী শিল্পী খুঁজে পাওয়া যেতো না, আর সে কারণেই নারীর চরিত্রেও দেখা যেতো পুরুষকে।

এ বিষয়টি না জেনে হয়ত কেউ কেউ এর মধ্যে “অশ্লীলতা” খুঁজছেন! তবে সব ছাপিয়ে গানটির জয়রথ এগিয়েই চলেছে। কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে তিন সপ্তাহে গানটি দেখা হয়েছে তিন কোটি বারেরও বেশি, যা এ চ্যানেলে প্রকাশিত যেকোনো বাংলা গানের ক্ষেত্রেই রেকর্ড। দুই কোটি ৪০ লাখ ভিউ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা “ভবের পাগল” শিরোনামের গানটি মুক্তি পায় এক বছর আগে। শিল্পী হিসেবে বাংলাদেশিদের কাছে প্রীতম আগে থেকে পরিচিত হলেও এখন “দেওরা” দিয়ে তিনি বিদেশেও পরিচিতি পাচ্ছেন। গানটি নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তা কেমন উপভোগ করছেন জানতে চাইলে প্রীতম বলেন, “সব প্রশংসা ফজলু মাঝির প্রাপ্য। তার গানটি আমি জাস্ট নিয়ে এসে নতুন করে রিঅ্যারেঞ্জড করেছি। এটাই ছিল আমার আসল কাজ। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে নতুন জেনারেশনের কাছে যেন আমাদের জারি-সারি গান ঠিকঠাক রিপ্রেজেন্ট করতে পারি। ভালো লাগছে এই ভেবে, গানের মূল ¯্রষ্টা এই গানের অংশ হতে পেরেছেন এবং সবাই তার কথা বলছেন।” তিন মিনিট ৪৭ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যরে গানটি নিয়ে নেতিবাচক কোনো অভিমত পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে প্রীতম বলেন, “মন্দ ফিডব্যাক আসলে সেভাবে পাইনি। পেলেও সেটি খুবই নগণ্য। মানুষের এত বেশি ভালোবাসা পাচ্ছি আসলে সেই অর্থে নেতিবাচক মন্তব্য চোখে পড়ছে না।” গুরু হাবিব ওয়াহিদ ও মায়ের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছেন বলে জানান প্রীতম।

এবার চেনা যাক ফজলু মাঝিকে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বনগ্রামের ফজলু মিয়া পেশায় কৃষক। তার বাবা ও ভাই একসময় নৌকার ভাইজাল (গায়ক) ছিলেন। তাদের কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া ফজলু কাজের ফুরসতে লিখে ফেলেন গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের জারি গান। নিজের মতো সুরও দেন। বর্ষা মৌসুম এলেই ফজলু বিভিন্ন এলাকায় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। নৌকায় বাইচাল ছাড়াও থাকেন একজন ভাইজাল, যিনি গানে-সুরে তাল দিয়ে বাইচালদের (চালক) উৎসাহ দেন। এতে নৌকার বাইচালদের মনোবল বাড়ে। মূলত নিজ এলাকায় নৌকাবাইচের গায়কের ভূমিকা পালন করেন ফজলু মিয়া। সেখানে “হাতে লাগে ব্যথা রে, হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে..” গানটি গেয়ে থাকেন। ফজলু মিয়ার নৌকাবাইচে গাওয়া গান ভিডিও করে অনেকেই আবার ইউটিউবে প্রকাশ করেন। এমন এক ভিডিওতেই সংগীত পরিচালক প্রীতম হাসানের চোখে পড়েন ফজলু মিয়া। কোক স্টুডিওতে কাজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে প্রীতম বলেন, “গানটি করার সময় অনেক ধরনের জটিলতা ছিল। সেটা উতরে গেছি। শাওন ভাই (গাউসুল আলম শাওন) লিরিক্স অ্যারেঞ্জমেন্টে সহযোগিতা করেছেন, বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়েছেন- এটা আমার জন্য বড় ব্যাপার। অর্ণব ভাই (শায়ান চৌধুরী অর্ণব) ছিলেন পুরো প্রজেক্টের মেন্টর, তার কাছে সবচেয়ে বড় সহায়তা পেয়েছিলাম।

মাঝখানে একটা জায়গায় আটকে যাচ্ছিলাম বারবার, কী করবো ভাবছিলাম, কিন্তু খুব স্পেসিফিক্যালি ভালো কিছু সলিউশন দিয়েছেন, যার কারণে গানটা ভালো দাঁড়িয়েছে। যেমন ইসলাম উদ্দিন পালাকার স্যারের সংযোজন এসেছে অর্ণব ভাইয়ের কাছ থেকে।” ইসলাম উদ্দিন পালাকার বাউলশিল্পী কুদ্দুস বয়াতির শিষ্য হিসেবে পরিচিত। ছোটবেলাতেই তিনি সংগীত অঙ্গনে নাম লেখান। বেড়ে ওঠেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাদ গ্রামে। দীর্ঘদিন তিনি কুদ্দুস বয়াতির বাড়িতে থেকে তার কাছ থেকে তালিম নেন। “ইসলাম উদ্দিন ও তার গানের দল” নামে একটি পালাগানের দল গঠন করেন, যার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। ইসলাম উদ্দিন পালাকার গান করেছেন দেশের বাইরেও। গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি গান রচনাও করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন। এ কারণে তাকে খুঁজে বের করতে প্রীতমের বেগ পতে হয়নি। “আসো মামা হে”, “লোকাল বাস”, “রাজকুমার”, “জাদুকর”, “গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে”র মতো জনপ্রিয় গান উপহার দিলেও বাউল ও লোক সংগীত শিল্পীদের নিয়ে প্রীতমের আলাদা আগ্রহ লক্ষ্যণীয়। “লোকাল বাস” গানে জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ ও “আসো মামা হে” গানে তিনি বাউলশিল্পী কুদ্দুস বয়াতিকে নতুন রূপে হাজির করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রীতম বলেন, “নানা ঘরানার কাজই করছি। সামনে অনেক ধরনের কাজের ইচ্ছে আছে, যেখানে নতুন নতুন বাউল শিল্পীদের তুলে ধরতে পারবো। শুধু ফজলু ভাই না, ফজলু ভাইয়ের মতো আরও অনেক ফজলু ভাই আছে, তাদেরকে ইন্ট্রোডিউস করতে পারলে ভালো লাগবে। চেষ্টা করবো তা-ই করতে।” নিজে নিজে কম্পোজিশন শেখা প্রীতম সংগীতের বিস্তর ধারণা পেয়েছেন হাবিবের কাছ থেকে। ছিলেন তার সহযোগীও। “হাবিব ভাইকে টুকটাক গানের মিউজিক করে দিতাম। পুরোদমে সংগীত প্রযোজক হওয়ার প্রেরণা ওঁর কাছ থেকে এসেছে। ভিন্ন ভিন্ন কাজের যে উৎসাহ সেটা ওঁর কাজ থেকে এসেছে,” বলেন তিনি।
প্রীতমের বাবা খ্যাতিমান প্রয়াত সংগীতশিল্পী খালিদ হাসান মিলু। নব্বইয়ের দশকের তুমুল জনপ্রিয় এই শিল্পী ২৫০টির মতো চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। একক, মিশ্র ও দ্বৈত মিলিয়ে প্রায় ১,৫০০-এর মতো গান গেয়েছেন তিনি। ২০০৪ সালে খালিদ হাসান মিলু অসুস্থ হয়ে আর্থিক সংকটে পড়েন। সে সময় বিটিভিতে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে খালিদ হাসান মিলু ও তার পরিবারকে একসঙ্গে দেখা যায়। সেদিনের ছোট্ট প্রীতমই এখন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় তরুণ শিল্পী।

বাবাকে নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো স্মৃতিটি মনে পড়ছে কি-না জানতে চাইলে প্রীতম বলেন, “বাবার অনেক স্মৃতি আমাদের মনে পড়ে। আমি এখন যে পর্যায়ে আছি সেটা বাবা দেখে যেতে পারলে ভালো হতো।” এ বছরের শুরুতে প্রীতম তার বন্ধু সংগীতশিল্পী জেফারের সঙ্গে বিশ্ব সংগীতের মর্যাদাসম্পন্ন আসর গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসে অংশ নিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, “বারবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। এখানে আমার সমস্ত প্রিয় অভিনয়শিল্পী ও সংগীতশিল্পীরা ছিলেন। কোল্ড প্লে, ক্যান্ডি ক্লেইনারের মেইন সিঙ্গার, ডুয়া লিপা প্রমুখ। স্পেশালি বিয়ন্সে যখন অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছিলেন সেই মুহূর্তটা ভালো লেগেছিল, সেটা দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।” প্রীতম বেশ কয়েক বার ছোট পর্দায়ও অভিনেতার ভূমিকায় হাজির হয়েছেন। কখনো ভবঘুরে প্রেমিক কখনোবা মুয়াজ্জিন চরিত্রে। “ইমোশনাল ফুল”, “৭০০ টাকা”, “পেট কাঁটা ষ”, “আড়াল” শিরোনামের স্বল্পদৈর্ঘ্যে অভিনয় করেছেন। অভিনয় নিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাইলে বলেন, “শখের বসে অভিনয় করলেও অনেক ধরনের অভিনয় করতে ভালো লাগে। যদি ভালো স্ক্রিপ্ট আসে আরও কাজ করতে চাই।” তবে এই মুহূর্তে সংগীতেই বেশি মনযোগী হতে চান। দর্শকদের উপহার দিতে চান “দেওরা”র মতো আরও অনেক গান।