নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ যান। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। নিষিদ্ধ যান বন্ধে উচ্চ আদালতের রায়, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন, পুলিশের অভিযান কিছুই কাজে আসছে না। বরং নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে চলছে ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান, নছিমন-করিমন ও ভটভটির মতো যানবাহন। এমনকি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অটোরিকশাও মহাসড়কে চলছে। ফলে দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে একই সড়কে ধীরগতির যানবাহন চলায় বছরে দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের প্রাণ হারাচ্ছে। সড়ক পরিবহন বিভাগ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী ইজিবাইকের মহাসড়কে চলাচল করারই কথা নয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ওসব সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে চলছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারাদেশে নিবন্ধিত ৫৭ লাখ ৪১ হাজার যানবাহনের মধ্যে সিএনজি ও জ্বালানি তেলচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮৯৩টি। তবে ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, নছিমন-করিমন ও ভটভটির সংখ্যা কত তা কেউ জানে না। পরিবহন মালিক শ্রমিক ও যাত্রী সংগঠনের হিসাবে সারাদেশে ওসব যানবাহন সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছর ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। ১ হাজার ৯৯টি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। ৮০১টি দুর্ঘটনায় নছিমন-করিমনের মতো যানবাহনের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
এ ছাড়া অটোরিকশা দুর্ঘটনা হয় ৫৯৯টি। এবারের ঈদযাত্রায় ২৭৭টি দুর্ঘটনার ২৩ শতাংশে ইজিবাইক ও নছিমন-করিমনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সূত্র জানায়, জীবিকা রক্ষার যুক্তিতে সড়ক-মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে না পেরে বৈধতা দিতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য নীতিমালার খসড়া করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে সরিয়ে গ্রামীণ রাস্তায় ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান, নছিমন-করিমন ও ভটভটিকে নিতে এই নীতিমালা করা হচ্ছে। এসব যানবাহনকে নিবন্ধন দেয়া হবে। তবে হাইকোর্ট শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিনে নির্মিত নসিমন-করিমন ও আলম সাধু বন্ধে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি আদেশ দিয়েছেন।
২০১৫ সালে ১ আগস্ট থেকে ২২ জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশাসহ ধীরগতির যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করে সড়ক পরিবহন বিভাগ। থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১ এর খসড়ায় বলা হয়েছে, সারাদেশে নিবন্ধিত ৪৯ লাখ যানবাহনের মাত্র দেড় শতাংশ বাস ও মিনিবাস। সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনবিহীন অসংখ্য নছিমন-করিমন, আলম সাধু, ভটভটি, ইজিবাইক, ব্যাটারির রিকশা চলছে। এসব গাড়ি কারিগরিভাবে সড়কের উপযোগী নয়। ব্রেক, স্টিয়ারিং ও সাসপেনশন মানসম্মত নয়। ফলে দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক হতাহতের বড় অংশই এসব ছোট যানবাহনের যাত্রী। কিন্তু সাশ্রয়ী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এসব যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল। সূত্র আরো জানায়, সারাদেশে অটোরিকশাসহ কমপক্ষে ১৫ লাখ নছিমন-করিমন, আলম সাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। তাতে অন্তত ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আর্থসামাজিক নিরাপত্তায় এসব যানবাহনকে অনুমতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার।
স্থানীয়ভাবে নির্ভরশীলতার কারণে বারবার চেষ্টা করেও এসব গাড়ি বন্ধ করা যায়নি। অবৈধ এসব গাড়ি চলার সুযোগ করে দিয়ে বছরে হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। বৈধতা দিলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, সরকার রাজস্ব পাবে। এদিকে সরকারের সড়ক পরিবহন দপ্তর সংশ্লিষ্টদের মতে, সড়ক-মহাসড়কে রাতারাতি নিষিদ্ধ যানবাহন বন্ধের উপায় নেই। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গণসচেতনতা। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে ইজিবাইক, ব্যাটারি রিকশাসহ অন্যান্য অনুমোদিত যানবাহন মহাসড়কে চলাচলের উপযোগী নয়। এগুলোতে চড়লে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। তবে বিকল্প না থাকায় সাধারণ মানুষ মহাসড়কে এসব যানবাহনে চড়ছেন। বিগত ২০১৫ সালে সরকারি ক্রয় মন্ত্রিসভা কমিটিতে ধীরগতির ব্যাটারিচালিত যানবাহন আমদানি বন্ধের প্রস্তাব উঠলেও কর্মসংস্থান রক্ষার যুক্তিতে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের বিরোধিতায় তা অনুমোদন পায়নি।
২০১১ সালে ইজিবাইক আমদানি বন্ধে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও উৎপাদন ও আমদানি দুই-ই চলছে। বিআরটিএ নিবন্ধন না দিলেও ঢাকার বাইরের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা চলাচলের অনুমতি দিচ্ছে। অন্যদিকে পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের মতে, ধীরগতির যানবাহনের কারণে মহাসড়কে বাস, ট্রাক বিপদে পড়ে। এগুলোর সংকেতবাতি নেই। ফলে কোন দিকে যাবে বোঝা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। আবার সামান্য ধাক্কায় এসব যানবাহন ভেঙেচুরে মানুষ মারা যান। মহাসড়কে বিভাজক স্থাপনের পর বাস ও ট্রাকের যত দুর্ঘটনা হয়েছে, তার বেশিরভাগ হয়েছে ধীরগতির গাড়ির কারণে। এগুলো বন্ধ না হলে বাসে দুর্ঘটনা চলতেই থাকবে। মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ক্যান্সারের মতো বেড়ে যাওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার মহামারি চলছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব আমিন উল্লাহ নুরী জানান, এখন স্থানীয়ভাবেও ব্যাটারিচালিত গাড়ি উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে নীতিমালা অনুমোদনের পর ব্যাটারিচালিত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থাকবে। তারা নিবন্ধন দেবে। মহাসড়কে এসব যানবাহন যাতে চলতে না পারে, তা নজরদারি করবে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি