মইনুল হোসেন :
গত শনিবার বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমানউল্লাহ আমানকে নিয়ে পুলিশ ও প্রধানমন্ত্রীসহ যে হাস্যকর নাটক সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। পুলিশ বিএনপির রাস্তায় অবস্থান আন্দোলনে বাধা দিতে গিয়ে দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। বিএনপির দু’জন নেতাকে পিটিয়ে জখম করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। রাস্তায় পড়ে থাকা ওই দুই নেতাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় এবং তাদের প্রতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনেক সদয় ব্যবহার করেন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও আমানউল্লাহ আমানের জন্য ফল পাঠানো হয়। তাকে সব ধরনের চিকিৎসা দেয়ারও আশ্বাস দেন। এসব ঘটনা নিয়ে একটি ভিডিও করা হয়। অনুমান করা হচ্ছে আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশসমূহকে আশ্বস্ত করতে যে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে নাই। পুলিশ তাদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করেছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার আগে বিএনপিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধান খন্দকার গোলাম ফারুক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ২৩ দফা দাবি পূরণের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হওয়ার শর্ত দিয়েছিলেন। অথচ সরকারের অবাধ নির্বাচনের মাত্র একটি শর্ত পূরণ করলে এই বিরোধী রাজনীতির যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি নিতে হতো না পুলিশকে।
বিরোধী দলকে নির্যাতন-নিপীড়ন করে সরকার যাতে ক্ষমতায় থাকতে পারে সেজন্য শাসনতন্ত্র সংশোধন করে জনগণের তথা আমাদের সবার অবাধ নির্বাচনের অধিকার হরণ করেছে সরকার।
জনগণের ভোটাধিকার হরণ করার ব্যাপারটি দলীয় রাজনীতির বিষয় নয়। বস্তুত, এর দ্বারা প্রতিটি নাগরিককে অধিকারহীন করা হয়েছে। অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে যদি জনগণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার বদলাতে না পারে তাহলে গোটা শাসনতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে।
আসন্ন জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে যদি প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে কারচুপি করতে না পারে তাহলে নির্বাচনী ফল যে সরকারি দলের জন্য বিপর্যয়কর হবে, এটা আওয়ামী লীগ ভালো করে জানে। সুতরাং যত কিছু হোক না কেন, তাদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন অবাধ হবে না।
সরকার নির্ভর করছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর নিপীড়নমূলক কার্যক্রমের ওপর, যেমনটি কমিউনিস্ট দেশগুলোতে হয়ে থাকে।
নির্বাচন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সাংবিধানিক সংশোধনীটি ছিল প্রতারণাপূর্ণ একটি কাজ। এর সাথে যোগ করা হয় সংসদ বাতিল না করে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান। ভোট ডাকাতির নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি করে আমাদের সবার অর্থাৎ জনগণের সরকার পরিবর্তনের অধিকার অস্বীকার করার ব্যাপারে সরকার কতটা বেপরোয়া তাই বোঝানো হয়েছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনকালে কোথাও নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকে না। সংসদ বিলুপ্ত না করে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজিরও কোথাও পাওয়া যাবে না। গণবিরোধী সরকারের ক্ষমতায় থাকার লোভের একটা সীমা থাকা চাই।
এখন আমাদের সংবিধানের পবিত্রতার কথা বলা হচ্ছে এবং সরকার অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে সংবিধান থেকে একচুলও সরতে পারবে না। বাস্তবে কিন্তু গণতান্ত্রিক সংবিধানকে অসম্মান করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের খ্যাতি আছে। ১৯৭৫ সালে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ বাকশাল-এর বিপ্লবী সরকার কায়েম করেছিল।
এখন কিন্তু সরকার বাকশালী পথে গণতন্ত্রকে অস্বীকার করতে গোটা শাসনতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটের মূলে যেতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো মূলত নামে রাজনৈতিক। ক্ষমতায় গেলে ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার মতলবকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এ উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীরা দলীয় রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন। ফলে দলীয় রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের চিন্তা-ভাবনাই বেশি কাজ করছে। যারা রাজনীতিবিদ তাদের মন-মানসিকতা একেবারে ভিন্ন ধরনের হতে হয়। একজন রাজনীতিকের মূলনীতি বা জীবন দর্শন হলো, তিনি ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে রাজনীতি করেন না। তিনি রাজনীতি করেন জনস্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে। এ জন্য রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করেন না। তাই রাজনীতি করে বিত্তশালী হওয়ার প্রশ্নও ওঠে না।
বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। রাজনীতি করে বিত্তশালী হওয়ার কাজটি কোনোরূপ অন্যায় বলে গণ্য করা হচ্ছে না। এ কথার অর্থ এই নয় যে, ব্যবসায়ীদের সাথে রাজনীতিকদের সম্পর্ক থাকবে না। অবশ্যই থাকবে। দেশের অর্থনীতির উন্নতি সাধনে ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। দেশবাসী আজ সেই জনকল্যাণের রাজনীতি দেখার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।
কিন্তু নিজে ব্যবসায়ীদের মতো সুযোগ-সুবিধা নেবেন না। তার নিজস্ব ব্যবসা থাকলে মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি তার ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনোভাবে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে তিনি কাজ করবেন না।
নিঃস্বার্থভাবে দেশ সেবার দায়িত্ব পালন করতে রাজনীতি একটি মহান পেশা। আমাদের রাজনীতিতে বিত্তশালী হওয়ার প্রতিযোগিতা আছে বলেই দেশে দুর্নীতির রাজত্ব চলছে। একজন রাজনীতিবিদ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকবেন এবং তা না হলে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নিতে হবে। এটাই গণতন্ত্রের মূল্যবোধ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে একজন রাজনীতিবিদকে দেখা হয় জাতির জন্য আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে।
ইংল্যান্ডের একজন প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় নিতে হয়েছে জেনেশুনে পার্লামেন্টে মিথ্যা তথ্য দেয়ার জন্য।
দেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার প্রয়োজনে সর্বাগ্রে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হয়। মন্ত্রীরা দুর্নীতি করে পার পাবেন আর অন্যেরা দুর্নীতি করবেন না- এরূপ আশা করা অবাস্তব। তাই দুর্নীতির মহামারী থেকে মুক্তি পেতে হলে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন শুরু করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি তদন্তের মাধ্যমে। আমাদের দেশে রাজনীতি করাই হয় দুর্নীতি আইন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। মুনাফা তোলার ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাজনীতিবিদ হওয়া যাবে না। বিভিন্ন ধরনের অন্যায় অবিচার থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে দলীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনীতিকরাই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হবেন।
তাই একজন রাজনীতিবিদ সত্যিকার অর্থে নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ হবেন। শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ নির্বাচিত হলেই চলবে না, জনগণের কাছে তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নিজ স্বার্থের জন্য ব্যক্তিপূজা কোনো রাজনীতি নয়।
সরকার একতরফাভাবে যে প্রহসনমূলক সংশোধনী শাসনতন্ত্রে সংযোজিত করেছে তার জন্য অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্ভব হবে না।
গত শুক্রবার বিএনপির ডাকে যে বিশাল জনসমাবেশ হয়েছে এবং সেই সমাবেশ থেকে যে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে, আমরা আশা করি সরকার তা বোঝার ক্ষমতা রাখে। নির্যাতন অব্যাহত রাখলে গণ-অভ্যুত্থানের ঝুঁকি বাড়বে, এ বিষয়ে সরকারকে সুপরামর্শ পেতে হবে। সরকারকে রাজনৈতিক ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানের পথে যেতে হবে। গণতন্ত্র হত্যা করতে প্রতারণাপূর্ণ সংবিধান সংশোধন করার নিশ্চয়তা দিলেই তো রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি আসবে। দলনিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে এটাই তো বিএনপির দাবি। তবে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করার মতো বিশ্বাস সরকারের ওপর নেই। তাই দাবি তোলা হয়েছে, সরকারের এখন পদত্যাগ করতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আমেরিকাসহ অন্য ১২টি রাষ্ট্রের চাপে আছে। পুলিশকে বুঝতে হবে যে আইন মেনে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলে না। আন্দোলনকারীদের অবশ্যই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা থাকবে। পরিস্থিতি বুঝে পুলিশকে পেশাগত দক্ষতা দেখাতে হবে। হামলা-মামলার পুলিশি তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। গ্রেফতার হওয়া শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে মুক্তি দিতে হবে।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম