নিজস্ব প্রতিবেদক:
সার সঙ্কটে দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে আমন ও আগাম শীতের সবজি চাষে সারের চাহিদা ৫ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে দেশে ইউরিয়া সারের মজুত প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টন। আর আগামী অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ১৬ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হবে। কারণ জানুয়ারিতে শুরু হবে ধানের প্রধান মৌসুম বোরোর আবাদ। অক্টোবরের শেষ থেকেই শীতকালীন সবজি ও পেঁয়াজের আবাদ শুরু হবে। সাধারণত এই সময়টিতেই সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু গ্যাস সঙ্কটে দেশের ৩টি সার কারখানার উৎপাদনই বন্ধ।
পাশাপাশি মার্কিন ডলারের সঙ্কট, সরবরাহকারীদের পাওনা ও দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারদের অনীহায় চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) শুরুতে সার আমদানি সঙ্কটের মুখে পড়েছে। কৃষিমন্ত্রণালয় চেষ্টা করেও এখনো এ সমস্যার সমাধান করতে পারছেনা। ফলে আগামী বোরো মৌসুমে সারের সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দ্রুত আমদানি করতে না পারলে সারের সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা তীব্র হবে। কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বছরে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন সারের চাহিদা রয়েছে।
এর বড় অংশ আমদানি হয়, বাকিটা দেশের কারখানায় উৎপাদন হয়। তবে উৎপাদন নির্ভর করে গ্যাস সরবরাহের ওপর। ২০২১-২২ অর্থবছরে সার বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫৯ লাখ টন। এর মধ্যে ৫২ লাখ টন আমদানি হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টনের কিছু বেশি। এর প্রায় ৪০ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। চলতি অর্থবছরের শুরুতে ছয় লাখ টন সার আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু দেশের বড় আমদানিকারকেরা তাতে সাড়া দেয়নি।
আর দেশে সার উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর মধ্যে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড ও আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের (এএফসিসিএল) মেরামত কাজের জন্য গত বছর বন্ধ করা হয়েছিল। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি গ্যাস সঙ্কটের জন্য গত মার্চ থেকে উৎপাদনে যেতে পারছে না। আর আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি গত জুন থেকে গ্যাসের অভাবে বন্ধ রয়েছে। নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় চালুর অপেক্ষায় থাকা ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিও গ্যাস সঙ্কটের জন্য সম্প্রতি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন বিসিআইসির অধীনে শুধু শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে ইউরিয়া উৎপাদন হচ্ছে। তবে এর উৎপাদন ক্ষমতা খুবই সামান্য।
সূত্র জানায়, দেশে সাধারণত তিন মাসের জন্য প্রয়োজনীয় সার মজুত থাকে। বর্তমানে প্রায় দেড় মাসের চাহিদা পূরণের মতো সার মজুত আছে। এরইমধ্যে গ্যাসের সঙ্কটে গত সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের সবচেয়ে বেশি সার উৎপাদনকারী কারখানা যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড। এটিসহ এখন বন্ধ তিনটি সার কারখানা। অথচ দেশে এখন ধানের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম আমনের আবাদ চলছে। জানুয়ারিতে শুরু হবে ধানের প্রধান মৌসুম বোরোর আবাদ। অক্টোবরের শেষ থেকেই শীতকালীন সবজি ও পেঁয়াজের আবাদ শুরু হবে।
সাধারণত এই সময়টিতেই সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার আমনে সারের চাহিদা অনেকটাই রেড়ে গেছে। গত জুলাই মাসে বৃষ্টি কম হয়েছে। এতে মাটির উবর্বতা কমে যাওয়ায় সারের প্রয়োজন বেড়েছে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষককে এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেশি সার জমিতে ব্যবহার করতে হবে। সূত্র আরো জানায়, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষি মন্ত্রণালয় গত এপ্রিলে সারের দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা করে বাড়ায়।
এখন কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা ও এমওপি ২০ টাকা। গত বছর সারে ভর্তুকি বাবদ সরকারকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। এ বছর বিশ্ববাজারে সারের দাম কমায় আশা করা হয়েছিল ভর্তুকি বাবদ ব্যয় কমবে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক দামে আমদানি করতে না পারলে বেশি খরচ পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। যদিও কৃষক পর্যায়ে এখনো সার নিয়ে সংকট হয়নি। তবে কোথাও কোথাও কৃষকদের সার কিনতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও সারের সঙ্কট দেখিয়ে কৃষকদের কাছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের কাছে সার সরবরাহকারীদের পাওনা প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
পাশাপাশি সার আমদানি করতে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। সেটারও সংকট চলছে ব্যাংক খাতে। এদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কৃষি খাতে চাষাবাদ ও ফসলের উৎপাদন ঠিক রাখার জন্য সারের নির্বিঘœ সরবরাহ জরুরি। কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে রাখতে সরকার ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করে। চলতি আমন ও আগামী জানুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া বোরো মৌসুমে সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকবে।
এ সময় সারের সরবরাহে ঘাটতি হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এখনকার বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে ফসল চাষের সার আমদানি নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণে নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে বিএডিসির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ সাজ্জাদ জানান, দ্রুত সার আমদানি চেষ্টা করা হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যে রাশিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে সার আসছে। আশা করা যায় বড় কোনো সংকট হবে না। যে তিনটি কারখানা এখন বন্ধ, সেগুলোতে ইউরিয়া উৎপাদিত হতো। গ্যাস না পেয়ে গত সপ্তাহে যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্যাস সঙ্কট কেটে গেলে আবার উৎপাদন শুরু হবে।
এ ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক জানান, ডলার-সংকটজনিত সমস্যা আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার-সংকট মোকাবিলা করার জন্য আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলছি। আমাদের কাছে এখন পর্যাপ্ত সার মজুত আছে। সামনের বোরোর আগে আমরা এসব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবো।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি