November 12, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, July 18th, 2022, 9:33 pm

পুষ্টি ঘাটতি বাড়াচ্ছে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশে পুষ্টি ঘাটতি বাড়াচ্ছে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে গ্রামীণ গৃহস্থালিগুলো তাদের দৈনন্দিন খাদ্য জোগানে আমিষ, ভিটামিন, খনিজসহ মানবদেহের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ৬টি উপাদান গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। দামের কারণে ন্যূনতম পরিমাণ সবজি, ফল, দুগ্ধজাত খাবার ও আমিষজাতীয় খাবার অনেকই পরিবারই জোগাড় করতে পারছে না। এদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হলো ভাত ও রুটি। কিন্তু বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ওই দুই খাদ্যের মূল উপাদান চাল ও গমের দাম বেড়েছে। বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও গমের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্যান্য খাদ্যশস্যের দামও বাড়ছে। এমন অবস্থায় মানুষ পরিবারে খাবারের পেছনে যে ব্যয় হয় তা কাটছাঁট করছে বা কমিয়ে আনছে। ফলে পুষ্টিকর খাবারের কাঠামোয় পরিবর্তন আসছে। দেশের অনেক পরিবার পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা অনুযায়ী শাকসবজি, ফলমূল, দুগ্ধজাত খাবার, মাংস ও মাছ গ্রহণের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। পুষ্টি বিজ্ঞানী এবং খাদ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য, জ¦ালানি ও সারের দামে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। তাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশেও খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিকর খাদ্যের সমতা নষ্টের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশ: ইমপ্যাক্টস অব দি ইউক্রেন অ্যান্ড গ্লোবাল ক্রাইসিস অন পভার্টি অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি’ শিরোনামের ওই গবেষণায় বৈশ্বিক খাদ্য, তেল ও সারের দামের ভারসাম্যহীনতা তুলে ধরা হয়েছে। তার প্রভাবে বাংলাদেশে শস্য উৎপাদন, শহুরে ও গ্রামীণ পরিবারগুলোর মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের সম্ভাব্য সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিকভাবে শস্য ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের পরিবারগুলোর দৈনন্দিন খাদ্য জোগানে টান পড়েছে। বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। মূলত খাদ্য, জ¦ালানি ও সারের বৈশ্বিক দামের ভারসাম্যহীনতার কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আর বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে উৎপাদন ও আমদানির জোগানে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ায় তার প্রভাব দেশের স্থানীয় বাজারে পড়েছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ ন্যূনতম একটি অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার জ¦ালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধিতে ওসবের ব্যবহার কমে যাওয়ায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ অতিরিক্ত একটি খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের বাড়তি ওই দামের কারণে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের পরিবারগুলোর সদস্যরা। প্রান্তিক পর্যায়ের ২ কোটিরও বেশি মানুষ একটি অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শহরাঞ্চলে ওই সংখ্যা ৭৬ লাখের মতো।
সূত্র আরো জানায়, বিশ্ববাজারে গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পাম অয়েল ও গমের দাম যথাক্রমে ৫৬ ও ১০০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে অপরিশোধিত তেলের দাম, সার ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দামের বেড়েছে। বাংলাদেশে গমের চাহিদার অর্ধেকের বেশি আমদানি করা হয়। ফলে বিশ্ববাজারের দামের ওপর আমদানি মূল্য নির্ভর করে। দাম বাড়লে আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারে স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে যায়। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এখনো দেশের বাজারে চাল ও গমের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আর ওই দাম ভোক্তার চাহিদার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া দেশের বেশির ভাগ খাদ্যশস্য উৎপাদন সারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ, ধান ও গমের জন্য ৯৫ শতাংশ, ডালে ৪৫ শতাংশ, আইরিশ আলু ও তৈলবীজ উৎপাদনে ৭০ শতাংশ, শাকসবজি উৎপাদনে ৪৫ শতাংশ, আখ উৎপাদনে ৯৫ শতাংশ, বাদাম উৎপাদনে ৩৫ শতাংশ, ফল উৎপাদনে ২৫ ও চা উৎপাদনে ৯০ শতাংশ সার ব্যবহার হয়। সারের দামের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতির কারণে কৃষক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি হিসাবি হয়ে উঠছে। সারের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকরা সার ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে এবং শস্যের দাম বাড়ছে।
এদিকে পুষ্টিবিদরা প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মোট ৬ ধরনের খাবার রাখার পরামর্শ দেয়। দৈনিক গড়ে একজন মানুষের ২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি খাদ্যের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে আমিষজাতীয় খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ১০-১২ শতাংশ থাকতে হয়। ভাত ও রুটি বা শর্করা জাতীয় খাবার থাকতে হবে ৬০-৭০ শতাংশ। আর বাকি ২০-২৫ শতাংশ তেলজাতীয় খাবার থেকে আসতে হয়। প্রতিদিন ভিটামিন ও খনিজ যেমন- শাকসবজি, ফলমূল খেতে হয়। শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণের জন্য দুধ খেতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুযায়ী দুধের অভাব রয়েছে। দুধের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আবার ক্রয়ক্ষমতার পার্থক্যের কারণে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সব পণ্য সমানভাবে কিনতেও পারে না। বিদ্যমান পরিস্থিতে আয় না বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য কিনতে পারছে না। ফলে তাদের খাবারের পরিমাণে কমবেশি করে প্রয়োজন ও সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় করতে হচ্ছে। এতে ভারসাম্যহীনতা প্রকট হচ্ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পৃথিবীর সব দেশেই পড়েছে। বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়লেও খাদ্যনিরাপত্তায় চরম সঙ্কটের আশঙ্কা নেই। কারণ দেশের বেশির ভাগ মানুষের কৃষিজমি রয়েছে। সেজন্য একটি ইতিবাচক দিক হলো দেশেই খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে তেমন শঙ্কা নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেদিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে।