October 8, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, June 22nd, 2022, 9:38 pm

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিম্নমুখী হলেও দেশের বাজারে সহসা কমছে না

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিশ্ববাজারে বেশ কয়েকদিন ধরে প্রায় সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম নিম্নমুখী হলেও দেশের বাজারে সহসা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং ভোজ্যতেলের আমদানি, পরিশোধন ও বিপণন কার্যক্রমকে বিশেষায়িত আখ্যা দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দ্রুততম সময়ের ব্যবধানে দাম সমন্বয়ের সুযোগ নেই। গত এক সপ্তাহে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম টনপ্রতি প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ডলার পর্যন্ত কমলেও তার সুফল পেতে দেশের ভোক্তাদের অপেক্ষা করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভোজ্যতেলের দামের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের প্রভাব বিশ্লেষণ করে আগামী কোরবানির ঈদের আগে দাম সমন্বয় করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিশ্বব্যাপী সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন এখন বাড়ছে। উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির খবরে বেশ কয়েকদিন ধরেই বিশ্ববাজারে সব ধরনের ভোজ্যতেলের মূল্যহ্রাস অব্যাহত রয়েছে। আর বাজার-সংক্রান্ত প্রায় সব পূর্বাভাসেই বলা হচ্ছে, ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারের নিম্নমুখিতা আরো বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকবে। শিগগিরই এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় দেশে দেশে ভোক্তা বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমানোর ঘোষণা দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে চিত্র বিপরীত। গত ১১ জুন সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের লিটারপ্রতি দাম ১৪ টাকা কমানো হলেও সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৭ টাকা। আর বাজার নীতিনির্ধারকদের মতে, শিগগিরই দেশে ভোজ্যতেলের দাম কমছে না।
সূত্র জানায়, সরকারের নির্দেশনার ভিত্তিতে আমদানিকারক ও মোড়কজাতকারী কোম্পানিগুলো দাম সমন্বয়ে অন্তত ৫ সপ্তাহ সময় নিচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের প্রভাবে আমদানিকারকরা লাভবান হলেও ভোক্তারা কোনো সুফল পাচ্ছে না। মূলত ফিউচার মার্কেট থেকে ভবিষ্যৎ সরবরাহের চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি হয়। আর স্পট মার্কেটের তাৎক্ষণিক সরবরাহের চুক্তিতে কেনা পণ্যের চেয়ে তার দাম সাধারণত কম হয়। ওই হিসেবে দেশের বাজারে এখন যে ভোজ্যতেল আসছে তা মূলত কয়েক মাস আগে কেনা। অথচ সরকার বিশ্ববাজারের এক মাস আগের মূল্য পর্যালোচনা করে দেশের বাজারে দাম নির্ধারণ করছে। তাতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তারা। যদিও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর ভোজ্যতেলের দাম পুননির্ধারণের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু এক মাস বা তারও বেশি সময় পর মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি ভোক্তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। তাতে বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না। দেশে গত ঈদুল ফিতরের পর ভোজ্যতেলের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। গত ৫ মে কোম্পানিগুলো ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করে। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দামও বাড়িয়ে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা কমে এলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত দাম কমানোর প্রত্যাশা তৈরি হয়। কিন্তু গত ১১ জুন সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের লিটারপ্রতি দাম ১৪ টাকা কমানো হলেও সয়াবিনের দাম ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ওই হিসেবে বাজারে এখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য দাঁড়িয়েছে ২০৫ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, মহামারীর প্রাদুর্ভাবজনিত স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার পর পরই বৈশ্বিক ভোক্তা চাহিদায় আকস্মিক উল্লম্ফন দেখা দেয়। বাড়তি চাহিদার তুলনায় মজুদ ও উৎপাদন কম থাকায় গত বছর অস্বাভাবিক হারে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর প্রায় দেশেই তার প্রভাব পড়ে। গত এক বছরে দেশে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে অন্তত ১০ বার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমানো হলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। দেশে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারে এখন পাম অয়েল মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৬ হাজার ৫০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ওই হিসেবে পাইকারিতে প্রতি লিটার পাম অয়েলের দাম পড়ছে ১৭৪ টাকা। কিন্তু খুচরায় তা আরো অন্তত ৪-৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে ভোজ্যতেল আমদানিকারক ব্যবসায়ীদেও মতে, গত রোজার আগে দেশীয় ভোক্তাদের ওপর বাড়তি দাম চাপিয়ে না দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করেছিল। যার কারণে ওই সময়ে আমদানিকারকরা ভোজ্যতেল বিপণনে বড় ধরনের লোকসান করে। ঈদের পর ব্যবসায়ীদের ওই লোকসান পুষিয়ে দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। হতে পারে ওই কারণেই বর্তমানে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দর সমন্বয়ে কিছুটা বিলম্ব করছে। গত রোজার ঈদের পর ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম পুননির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই সময়ে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি রেকর্ড ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। তারপর গত ৯ জুন মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। তার মধ্যে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তাছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৯৯ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের খোলা পাম অয়েলের (সুপার) দাম মিলগেটে ১৫৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৫৫ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৮ টাকা করা হয়। সেক্ষেত্রে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি ৫-৭ টাকা। পাম অয়েলের দাম কমানো হয়েছে লিটারপ্রতি ১৪ টাকা।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঁচ থেকে সাতটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের ভোজ্যতেল বাণিজ্য। আগে আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছিল, যারা ঋণখেলাপের দায়ে মার্কেট থেকে সরে গেছে। এ সুযোগে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভোজ্যতেলের বাজারে প্রভাব বিস্তার করায় বৈশ্বিক দর ওঠানামার সঙ্গে দেশের বাজারে দাম নির্ধারণের সামঞ্জস্য দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও সংকটকালে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে শুধু দাম বেঁধে দিলে হবে না। তার সঙ্গে তথ্য সরবরাহ ও অতিমুনাফার ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানও নিতে হবে। তাছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী জানান, ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, ভোজ্যতেল আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি রয়েছে। কমিটির সদস্যরা বৈঠকের মাধ্যমে বিগত কয়েক মাস আগে আমদানি হওয়া ইনবন্ড-আউটবন্ড ভোজ্যতেলের তথ্য পর্যালোচনা করে দাম নির্ধারণ করে। সেজন্য একটি সূত্র মেনে চলা হয়। যার কারণে বর্তমান সময়ে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও এর সুফল পেতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়। সর্বশেষ দাম সমন্বয় হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। নতুন দাম ঘোষণা করতে অন্তত আরো এক মাস লাগবে।