November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, November 3rd, 2021, 7:34 pm

কয়লা সংকটে ফরিদপুরে ইট উৎপাদন বন্ধ

ফরিদপুরে ইটভাটায় জ্বালানি সংকট ও উচ্চ মূল্যের কারণে চলতি মৌসুমে এখনো উৎপাদন শুরু করতে পারেনি ভাটা মালিকরা। এর ফলে প্রায় ২০ হাজার ইট ভাটা শ্রমিক বেকার (কর্মহীন) অবস্থায় রয়েছে।

জেলা ভাটা মালিক সমিতি জানিয়েছে, ফরিদপুর জেলায় ছোট বড় ১২৮টি ইটভাটা রয়েছে। তার মধ্যে ৮টি দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। চালু রয়েছে ১২০টি ভাটা, এর মধ্যে অটো ইটভাটা রয়েছে ৭টি বাকি ১১৩টি ইটভাটা চলে কয়লা পুড়িয়ে।

গত মৌসুমে ভাটা মালিকরা ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত জ্বালানি (কয়লা) টন প্রতি সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকায় কিনেছিল। কিন্তু চলতি মৌসুমে করোনা মহামারির কারণে কয়লা আমদানি সংকট রয়েছে। এরপরও আবার যা পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য টন প্রতি ১৯ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। আর তাই ভাটা মালিকেরা সময় মতো ভাটায় ইট কাটা শুরু করতে পারছে না।

সরেজমিনে ফরিদপুরে সদর উপজেলার ডিক্রীরচর, নর্থচ্যানেল ও চরমাধবদিয়া ইউনিয়নে বিভিন্ন ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, গত বছরের উৎপাদিত ইট এরই মধ্যে বিক্রি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু নতুন করে উৎপাদনে না যাওয়ায় ফরিদপুরে ইট সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি উন্নয়ন কাজে ঠিকাদাররা ইট কিনে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। আর নতুন ইট উৎপাদনের পর যে দামে বিক্রি হবে তা বর্তমান বাজার দরের দ্বিগুণ। তাই মাথায় হাত পড়েছে বাড়ি করতে চাওয়া সাধারন মানুষ ও নতুন করে কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের।

সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ সময় থেকে ইট উৎপাদনে যায় ভাটা মালিকেরা। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়েই মাটি কেনা, মাটি থেকে কাচা ইট তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাচা ইট রোদে শুকিয়ে অক্টোবর মাসেই প্রথম কিস্তি ইট পোড়ানো শুরু করে। কিন্তু নভেম্বর মাস শুরু হয়ে গেলেও ইট উৎপাদন শুরু করতে পারেনি ভাটাগুলো।

ভাটা মালিকেরা বলছেন, গতবছর একটন কয়লা কিনেছি সাড়ে ৮ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ সেই একই সময়ে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এখন প্রকারভেদে ১৯ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা দামে এক টন কয়লা বিক্রি হচ্ছে। তা-ও আবার পযাপ্ত পরিমাণে না।

ফরিদপুর ডিক্রীরচর ইউনিয়নের ধলার মোড় এলাকার এম এ বি ব্রিকস এর মালিক মো. আব্দুস সালাম জানান, একটি মৌসুমে ৮ রাউন্ডে ৭ থেকে ৮ লাখ করে মোট ৫০ থেকে ৬০ লাখ ইট তৈরি হয়। একেক রাউন্ডে ইট পোড়াতে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। এবছর কয়লার দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় মৌসুমের প্রায় ৪৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ইট উৎপাদন শুরু করেননি তিনি। শুধু তিনি নন কোন ইটভাটার চিমনিতে ধোয়া উড়ছে না। ইট প্রস্তুতকারী মাঠও ফাঁকা পড়ে রয়েছে।

আব্দুস সালাম আরও জানান, প্রতি রাউন্ডে ৭ থেকে ৮ লাখ ইট পোড়াতে প্রায় ১৩০ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। এতে ৮ রাউন্ড পোড়ালে ১ হাজার টনের বেশি কয়লা প্রয়োজন হয় আমার ইটভাটায়। এই ভাটা মালিক বলেন, ‘আমি ১ হাজার টন কয়লা কিনেছি ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার মধ্যে। সেই কয়লা এবার কিনতে হবে সোয়া ২ কোটি টাকায়। আবার শুধু যে টাকা হলেই কয়লা মিলছে তও না। টাকা দিয়েও সময় মতো কয়লা সাপ্লাই পাওয়া যাচ্ছে না।’

একই কথা বলেন আরেক ভাটা মালিক আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা। তিনি বলেন, গত মৌসুমে একটি ইটের উৎপাদন খরচ ছিল সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ টাকার মধ্যে। কিন্তু চলতি মৌসুমে একটি ইট উৎপাদনে ১০ থেকে ১১টাকা খরচ হবে। নতুন এক হাজার ইটের দাম হবে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এতো দামে মানুষ ইট কিনবে কি না সে নিয়েও চিন্তায় রয়েছি ।

শহরতলীর সিএন্ডবি ঘাট এলাকার রউফ ব্রিকসের সুপার ভাইজার মিজানুর রহমান জানালেন, ইটভাটা করতে হলে বিভিন্ন জেলার ইট প্রস্তুতকারী শ্রমিকদের মৌসুমের কমপক্ষে ছয়মাস আগে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা অগ্রীম দিতে হয়। অগ্রীম নেয়া শ্রমিকেরা কাজ করতে আসতে পারছে না। ফলে প্রতিটি ভাটায় প্রায় ৭০ থেকে ১০০ জন শ্রমিক কাজে আসার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। এখন কাজের ধুম পড়ে যাওয়ার কথা,অথচ মৌসুমের শুরুতেই কাজে ভাটা পড়েছে। স্থানীয় শ্রমিকেরাও বেকার দিনযাপন করছে।

কয়েকজন ইটভাটা মালিক জানান, ফরিদপুরে ৫-৭ জন ব্যবসায়ী ইটভাটা গুলোতে কয়লা সরবরাহ করে থাকে। এই ব্যবসায়ীরা ভরা মৌসুমে মংলা বন্দর থেকে নৌপথে ফরিদপুর সিএন্ডবিঘাটে (নৌ বন্দরের) কয়লা নিয়ে আসে। নদীতে পানি কমে গেলে যশোরের অভয়নগর উপজেলার শিল্প এলাকা নওয়াপাড়া থেকে সড়ক পথে কয়লা আনেন। সাধারণত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাতে নওয়াপাড়া থেকে কয়লা সরবরাহ হয়ে থাকে।

ফরিদপুরের কয়লা ব্যবসায়ী মুজিবর মাতুব্বর বলেন, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আমদানি করা হয় দেশে। আর্ন্তজাতিক বাজারেও কয়লার দাম বৃদ্ধি ও শিপমেন্ট খরচ বেড়ে যাওয়ায় কয়লা আমদানিতে খরচ বেড়েছে। ফলে আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুনের বেশি দামে কয়লা বিক্রি করতে হচ্ছে। মূলত মোংলা ও নওয়াপাড়ার আমদানি কারকদের কাছে থেকে কয়লা এনে ফরিদপুরে বিক্রি করি। ২০০ থেকে ৫০০ টাকা টন লাভে ফরিদপুরে কয়লা বিক্রি করে থাকি। এবছর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ফরিদপুরের ইট ভাটা মালিকেরা এখন কয়লা কিনতে চাচ্ছে না।

ফরিদপুর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি খলিফা কামাল উদ্দিন ইট উৎপাদনের এই সংকটের বিষয়ে বলেন, ৮ হাজার টাকার কয়লা ২২ হাজার টাকায় কিনে ভাটা চালু করা ব্যবসায়িক ঝুঁকি মনে করছে ইটভাটা মালিকেরা। ফলে বেশিরভাগ ইটভাটা এই মৌসুমে ইট উৎপাদনে যেতে পারেনি।

তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এখনই উদ্যোগ না নিলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে শুরুতে বাজারে যে নতুন ইট আসবে সেই ইটের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় জনসাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাবে। শুধু তা-ই নয় সরকারি কাজেও ধীরগতি চলে আসবে।

ভাটা মালিকদের এই নেতা আরও বলেন, ‘ইটভাটা মালিকদের লাভ লোকসান যাই হোক ইটের দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। আর তাই, যতদ্রুত সম্ভব বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

—ইউএনবি