নিজস্ব প্রতিবেদক:
ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সড়ক-মহাসড়ক। পরিবহনের ক্ষেত্রে দেশে এক্সেল লোড নীতিমালা থাকলেও কেউ তা মান্য করছে না। বরং অতি লাভের কারণে পণ্যবাহী যানের চালক ও শ্রমিকেরা ওজনসীমার অতিরিক্ত মালামাল পরিবহন করছে। আর বাড়তি ওজন নিয়ে যান চলাচলের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। একই কারণে সর্বোচ্চ ব্যয়ে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের পরও আয়ুষ্কালের অর্ধেক সময়ও টিকছে না। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একটি সিঙ্গেল এক্সেল সর্বোচ্চ ১০ টন লোড বহন করার কথা থাকলেও মহসড়কগুলোতে যানবাহনে প্রায়ই ২০ টন এক্সেল লোডের ট্রাক চলাচল করছে। আর এভাবে একটি সড়কের ওপর দিয়ে ট্রাক সর্বসাকুল্যে ১৭০ বার চলাচল করলে সড়ক ক্ষতি হতে বাধ্য। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল ঠেকাতে সরকার ২০১২ সালে এক্সেল লোড নীতিমালা প্রণয়ন করে। কিন্তু গত ১০ বছরেও নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত পণ্য বহনের দায়ে জরিমানা আদায় করা যায়নি। নীতিমালায় অনুযায়ী মহাসড়কে চালাচলকৃত ছয় চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ২২ টন, ১০ চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ৩০ টন এবং ১৪ চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ৪০ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই নীতিমালা না মানলে ২ থেকে ১২ হাজার জরিমানা গুনতে হবে। সেজন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেতু ও মহাসড়কের পাশে পণ্যসহ গাড়ি পরিমাপের জন্য এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশনও স্থাপন করে দিয়ে চাকাভেদে প্রতিটি শ্রেণির গাড়ির জরিমানার হারও নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের জন্য ৪টি ধাপ পর্যন্ত ওই জরিমানা দিতে হবে। জরিমানার হার সর্বনিম্ন ২ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা। যেমন ৬ চাকার গাড়ি ১৫ টনের বেশি, অর্থাৎ সাড়ে ১৬ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করলে ২ হাজার টাকা, সোয়া ১৭ টন পর্যন্ত করলে ৪ হাজার টাকা, ১৮ টন পর্যন্ত ৬ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ পৌনে ১৯ টন পর্যন্ত করলে ১২ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। একইভাবে ২৬ চাকার গাড়ি ৪৮ দশমিক ৪ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করলে ২ হাজার টাকা, ৫০ দশমিক ৬ টন পর্যন্ত ৪ হাজার টাকা, ৫২ দশমিক ৮ টন পর্যন্ত করলে ৬ হাজার এবং ৫৫ টন পর্যন্ত করলে ১২ হাজার টাকা জরিমানা নির্ধারণ করলেও ওই নীতিমালা মোটেও মানা হচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে যান চলাচলের কারণে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জেলায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
সূত্র জানায়, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর ২০ বছর টেকার উপযোগী করে সড়ক নির্মাণ করে। ওই সড়কের ওপর দিয়ে পাঁচ টনের ট্রাকে বহন করা হচ্ছে ১০-১২ টন মাল। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়ক, মহাসড়ক ও ব্রিজ। মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে যন্ত্র বসানো হলেও তা ঠিকভাবে এখনো কার্যকর হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি ওজনের পণ্যবাহী যান থেকে টাকা নিয়ে তা চলতে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। অথচ মহাসড়কে প্রতিটি যানবাহনের জন্য নির্ধারিত ওজন বেঁধে দেয়া হলেও বাস্তবে প্রায় সব ট্রাকসহ অন্যান্য ভারী পরিবহন দ্বিগুণ-তিনগুণ ওজনের পণ্য বহন করে। ফলে বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও সেতু নির্মাণ বা মেরামতের ছয় মাস বা এক বছরের মাথায় ফাটল, বিটুমিন উঠে যাওয়া, খানাখন্দের সৃষ্টি হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। যে কারণে প্রতি বছর সড়ক, মহাসড়ক এবং সেতুর ক্ষতি হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
এদিকে এ বিষয়ে সড়কে ওভার লোড ঠেকাতে গঠিত কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রোস্তম আলী জানান, সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত মালামাল বহনের বিষয়টি যারা তদারিক করার কথা তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না। এখন পর্যন্ত যেসব বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়েছে তার সিংহভাগই অতিরিক্ত ওজনের কারণে ঘটেছে। তদন্ত করে দোষি ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং ওভার লোড বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো গাড়ির ওজনসীমা কত হবে, তা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে। ব্লু বুক অনুযায়ী ছয় চাকার চার এক্সেল গাড়িতে সাড়ে ১৫ টন বা ১৬ টন পণ্য বহনের সক্ষমতা রয়েছে। তা আরো বাড়ালে নিশ্চিতভাবেই সড়কের ক্ষতি হবে। ১০ চাকার গাড়ির পণ্য বহন ক্ষমতা ২৬ টন। প্রাইম মুভারের ক্ষেত্রে চার এক্সেলের গাড়ি হলে ৩৩ টন, পাঁচ এক্সেলের হলে ৪২ টন পণ্য বহন করতে পারে। তার বেশি পণ্য বহন করলে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান জানান, যতো ভালো মানেরই সড়ক বানানো হোক না কেন ওভারলোডিং হলে তা দ্রুত নষ্ট করে ফেলবে। এখানে এ ঘটনাই বেশি হচ্ছে। ওভারলোডিংয়ের কারণে রাটিংয়ের মতো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে এক্সেল লোড-সংক্রান্ত নীতিমালা কার্যকর রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সড়কে ওভারলোডিং নিয়ন্ত্রণের জন্য ওজনসীমা নিয়ন্ত্রণ স্কেল বসানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মহাসড়কগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম