নিজস্ব প্রতিবেদক:
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে। শিল্পকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ, নেতিবচক জলবায়ুর কারণে হুমকিতে পৃথিবী। এ নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সংকট মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগও আছে বিভিন্ন দেশের। তবে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে করেছে বাংলাদেশ। পোশাক উৎপাদনে পরিবেশসহায়ক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সবুজ কারখানা এখন বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে নতুন করে সবুজ কারখানা হিসেবে সম্প্রতি আরও দুটি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি মোলায় পোশাক খাতে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৩টিতে। সম্প্রতি ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) এ স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানায়, এখন পর্যন্ত দেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতের ২১৩টি কারখানা লিডারশিপ ইন অ্যানার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন তথা লিড সনদ পেয়েছে।
এর মধ্যে লিড প্লাটিনাম ৮০টি কারখানা, লিড গোল্ড ১১৯টি, সিলভার ১০টি ও সার্টিফায়েড ৪টি। নতুন সবুজ কারখানার সনদ পাওয়া কারখানা দুটি হলো: উইন্ডি অ্যাপারেলস লিমিটেড ও কমফিট বানানা লিফ। এর মধ্যে উইন্ডি অ্যাপারেলস ৬৯ পয়েন্ট নিয়ে গোল্ড রেটিং পেয়েছে। আর কমফিট বানানা ৭৩ পেয়েন্ট পেয়ে গোল্ড রেটিং পেয়েছে। জানা যায়, ‘লিড’ সনদ পেতে হলে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়।
মূলত ভবন নির্মাণের পরে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও প্রতিষ্ঠানটিতে আবেদন করা যায়। লিড সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০-৪৯ পয়েন্ট হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ পাওয়া যায়। বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৫৪টি এবং শীর্ষ ২০টি লিড সনদপ্রাপ্ত গ্রিন কারখানার ১৮টিই বাংলাদেশে অবস্থিত।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশে লিড স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এই সংখ্যা দেশের টেকসই তৈরি পোশাকশিল্পের বিষয়ে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তার প্রমাণ। আমাদের সদস্যরা পরিবেশবান্ধব চর্চা, জ্বালানি সাশ্রয়ী পদক্ষেপ ও পানির ব্যবহার কমানোর মতো উদ্যোগ গ্রহণ করে যাচ্ছেন। এ কাজে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসছে এবং বিনিয়োগ করছে; যা খুবই ইতিবাচক। জানা যায়, ১৯৯৩ সাল থেকে সবুজ কারখানার আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি সনদ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবি)।
বাণিজ্যিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনার ক্ষেত্রেও এই সনদ দেয় ইউএসজিবি। শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন পর্যন্ত ছোট-বড় সব পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি কতটা মানা হলো- তার চুলচেরা বিশ্নেষণ করে এ সনদ দেওয়া হয়। দেশে নতুন বিনিয়োগের অনেক কারখানাই এখন সবুজ প্রযুক্তিতে নির্মাণ হচ্ছে। সবুজ কারখানায় রূপান্তরের চেষ্টা করছে পুরোনো বেশ কিছু কারখানাও। লিড সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলে পোশাক খাতের এই সবুজ বিপ্লব বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে। জানা যায়, লিড সনদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষা এবং সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাশ্রয়ী উৎপাদন।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিদেশি বড় ব্র্যান্ড এবং ক্রেতার আস্থা বাড়ে এতে। ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে এগিয়ে থাকা যায়। দেশের এবং পোশাক খাতেরও ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ে। এসব কারখানায় সাধারণত দুর্ঘটনা হয় না। প্রাকৃতিক আলো-বাতাসেই চলে উৎপাদন। কারখানার ভেতর সার্বক্ষণিক সহনীয় তাপমাত্রা থাকে। কাজের পরিবেশ থাকে নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত। নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ব্যবহারের সুবিধায় পানি, বিদ্যুৎ কম খরচ হয়। বর্জ্য নিঃসরণ কম হওয়ায় এর শোধন প্রক্রিয়ার ব্যয়ও কম হয়।
সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন ব্যয় কমে আসে। এ ছাড়া সবুজ কারখানায় উৎপাদিত পোশাকের গায়ে একটি গ্রিন ট্যাগ থাকে। সচেতন ভোক্তাদের কাছে এর উচ্চ কদর রয়েছে। এদিকে, একটি সাধারণ কারখানা নির্মাণে যে পরিমাণ বিনিয়োগ লাগে, সবুজ প্রযুক্তিতে তা নির্মাণে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হয়। তারপরও কেন উদ্যোক্তারা সবুজ প্রযুক্তিতে ঝুঁকছেন- এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন ও এর অভিঘাতের জন্য প্রধানত প্রচলিত শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। পরিবেশ বিপন্ন করে শিল্প উৎপাদনের প্রচলিত ব্যবস্থা বেশি দিন টিকতে পারবে না।
আগাম এই ধারণা থেকেই উদ্যোক্তারা সবুজ শিল্পে ঝুঁকছেন। সম্প্রতি জলবায়ু সম্মেলনে কয়েকটি ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বলেছে, যেসব কারখানা সবুজ প্রযুক্তিতে গড়ে ওঠেনি, ২০৩০ সালের পর সেসব কারখানা থেকে আর পোশাক নেবে না তারা। কাজ হারানোর এই ঝুঁকি নেই সবুজ কারখানায়। এদিকে ইউএসজিবিসির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সাধারণ একটি কারখানার তুলনায় লিড সনদ পাওয়া কারখানার জ্বালানি সাশ্রয় ২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। পানির ব্যবহার কম হয় ৪০ শতাংশ। বর্জ্য উৎপাদন কম হয় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কম হয় ১৩ শতাংশ।
একটি রেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে কারখানার নকশা, নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর লিড সনদ দেওয়া হয়। ছোট বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়ে বিশ্নেষণ করা হয়। যেমন, শুধু কারখানার অবস্থান সূচকেই ২৬ রেটিং পয়েন্ট বিবেচনা করা হয়। স্থানীয়দের সহজ যাতায়াত, পরিবহন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও পয়েন্ট রয়েছে। এদিকে, পরিবেশ রক্ষায় সবুজ কারখানা নির্মাণে উৎসাহিত করছে সরকার। পোশাক খাতে করপোরেট কর সুবজ কারখানা হিসেবে সনদপ্রাপ্ত কারখানার জন্য কম করা হয়েছে। স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সবুজ প্রযুক্তি শিল্পকারখানায় অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তহিবল আছে, যেখান থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি